নদীমাতৃক বাংলাদেশে ফাল্গুনের শুরুতেই পানির জন্য হাহাকার পড়েছে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভারত অভিন্ন নদীগুলোর পানি অন্যায়ভাবে প্রত্যাহার করে নেয়ায় দেশের অধিকাংশ নদ-নদীই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। এ সংক্রান্ত খবরে বলা হয়েছে, চৈত্র মাস আসতে না আসতেই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে লাখ লাখ হেক্টর কৃষি জমি ফেটে চৌচির। খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় কৃষক সেচের পানির জন্য চোখের পানি ফেলছে। পানির অভাবে এবার মুহুরি সেচ প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প, জিকে সেচ প্রকল্প, রাজশাহী সেচ প্রকল্প, তিস্তা সেচ প্রকল্পের সিংহভাগ জমি সেচের আওতায় নেয়া সম্ভব হয়নি। সর্বত্রই পানির জন্য চলছে হাহাকার। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হবার পিছনে মূল যে কারণ সে ব্যাপারে দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় ৭ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে জেআরসি’র মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক। মূলত ঐ বৈঠকের উপর অনেকটাই নির্ভর করে অভিন্ন নদীর পানি সমস্যার সমাধানের বিষয়টি। তারা মনে করছেন ভারত কৌশলে জেআরসি’র বৈঠক না করে ইচ্ছামত পানি তুলে নিচ্ছে। এদিকে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, কৃষির পর্যাপ্ত পনি সমস্যার সমাধান করতে না পারলে শুধু পরিবেশ বিপর্যয় নয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দেশ।
বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর নাব্যতার সংকট এখন পুরোনো বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় পত্র-পত্রিকাতেও এসম্পর্কে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। একথাই সত্যি যে, পরীক্ষামূূলকভাবে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালুর কথা বলে সেই যে বিপদের সূত্রপাত করেছে তার ধারাবাহিকতাই চলছে। এরপর যে দু’একটি চুক্তি হয়েছে বলে বলা হচ্ছে দেখা যাচ্ছে সে সব চুক্তিরও কোন তোয়াক্কা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ করছে না। দু’দেশে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা হওয়া সত্তে¡ও তিস্তাচুক্তির ব্যাপারে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই। সামগ্রিকভাবে এটা বলা যায়, কেবলমাত্র ভারতীয়রা পানি দিচ্ছে না এটা যেমনি সত্যি, তেমনি আমাদের পক্ষ থেকেও পানি পাবার কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তার কোন সুস্পষ্ট আলামত নেই। বর্তমান সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্ককে বিশেষ বিবেচনায় দেখা হচ্ছে এবং দু’দেশের সম্পর্ক সর্বোচ্চ মাত্রায় রয়েছে বলেও বলা হচ্ছে। অবস্থা যখন এই তখন সঙ্গতভাবেই বাংলাদেশের জনগণ আশা করতে পারে যে তাদের জীবন-মরণ প্রশ্ন পানি পেতে কোন সমস্যা হবার কথা নয়। এটাও নতুন করে বলার অপেক্ষ রাখে না যে কোন শর্ত ছাড়াই এমনকি কিছু পাবার আশা না করেই আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি; যার বিনিময়ে ভারত হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থিক সুবিধা পেয়েছে। সাধারণ বিবেচনায় দু’টি স্বাধীন দেশের সম্পর্ক পারস্পরিক স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে দেয়া-নেয়ার ব্যাপারটিও সমতার ভিত্তিতেই হবার কথা। এখন দেখা যাচ্ছে, আমরা ভারতকে ট্রানজিট সুবিধাসহ নানা ধরনের সুবিধা দিয়েছি এবং দিচ্ছি অথচ তার বিনিময়ে পানির ন্যায্য হিস্যাটুকুও পাচ্ছি না। এমনকি আমরা ঠিকমত চাইছি কিনা সেটাও পরিষ্কার নয়। দেশে পদ্মাসেতুর নির্মাণ নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। এটিকে উন্নয়নের একটি নবদিগন্তের সূচনা হিসেবে মনে করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে পদ্মা সেতু নাকি গঙ্গা ব্যারেজ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অধিকতর প্রয়োজনীয়। এটা বারবার বলা হচ্ছে, গঙ্গা ব্যারেজের মাধ্যমে বর্ষাকালীন পানি ধরে রাখা গেলে এবং নদ-নদীগুলো খনন করা গেলে বছরব্যাপী পানি সমস্যার অনেকখানি সমাধান সম্ভব। এটি অনেক দিনের পুরনো আলোচনা। অদ্যাবধি এব্যাপারে কার্যকর কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। নদ-নদীগুলো খনন ও তীররক্ষা নিয়ে এপর্যন্ত যতটুকু কাজ করা হয়েছে সেখানে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এবং দখলদারদের স্বার্থ সংরক্ষণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। এখন দেখা যাচ্ছে যে, পানির অভাবে এবছর বিভিন্ন এলাকায় বহু জমি কৃষির আওতার বাইরে রয়েছে। পানি না থাকলে সাধারণ কৃষিও সম্ভব নয়। কৃষিনির্ভর এদেশে যদি প্রধান কৃষি চাষ বিঘিœত হয় তাহলে দেশের অর্থনীতির উপর কতটা চাপ পড়বে সেটি বোধকরি লিখে বুঝাবার কোন প্রয়োজন নেই। ইতোপূর্বে এক রিপোর্টে বলা হয়েছে খাদ্য আমদানির কারণে অর্থনীতির উপর চাপ বাড়ছে। এর বাইরে পরিবেশের যে আলোচনা রয়েছে তাতো থাকছেই। পানির অভাবে মরুময়তা দেখা দিচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব মানুষের উপর পড়তে বাধ্য। মিঠা পানির অভাবে নোনা পানির কারণে দেশের কোন কোন অঞ্চলে খবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সব মিলে এটা বলা যায়, পানির দেশে পানির অভাবের কারণে এক ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এটি মেকাবিলা করার জন্য কার্যত কোন প্রস্তুতি নেই।
ভারতের বৈরী পানি নীতির কারণে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো পনি শূন্য হয়ে যাচ্ছে। আবার বর্ষায় অতিরিক্তি পানির কারণে বন্যা দেখা দিচ্ছে। বন্যায় টেনে আনা বিপুল পলির কারণে নদ-নদীগুলো অরো বেশি শুকিয়ে যাচ্ছে। নদ-নদীগুলোর একটা বয়স আছে। অব্যাহতভাবে এভাবে পানিশূন্য থাকার ফলে এগুলো এমনিতেই মরে যাবে। সে বিবেচনাতেও নদ-নদী বাঁচিয়ে রাখতে পানির ব্যবস্থা করা জরুরি। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে স্বাভাবিকভাবে ভারত পানি দেবে এমনটা বোধহয় মনে না করাই সঙ্গত। অনেক আগে থেকেই পানি পাবার জন্য যে দু’টি প্রস্তাবের কথা বলা হচ্ছিল তা হচ্ছে হিমালয়ের পাদদেশে তিন দেশের সমন্বয়ে জলাধার নির্মাণ। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, শুষ্ক মওসুমে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতেও ভারতের আপত্তি রয়েছে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে আন্তর্জাতিক ফোরাম তথা আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টি নিয়ে যাওয়া। এ ব্যাপারে অনেকেই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রসঙ্গ তুলে ধরছেন। মূলত ভারতীয় বাধার কারণে সেখানেও বাংলাদেশ যাচ্ছে না। হতে পারে ভারতের অভ্যন্তরে যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চলছে সেগুলো শেষ হলে এমনিতেই যখন বাংলাদেশ পানিবঞ্চিত হবে তখন আর আলোচনার সুযোগ থাকবে না। হতে পারে ভারতীয়রা হয়ত সে সময়েরই অপেক্ষা করছে। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন বাস্তবতা হচ্ছে পানি না পেলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। এখন পর্যন্ত হয়ত ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে আপাত কিছু সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে পানি পাওয়া না গেলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেও টান পড়তে বাধ্য। কিভাবে কেমন করে পানি পাওয়া যাবে সেটি মূলত দেখার বিষয় সংশ্লিষ্টদের। জনগণ পানি চায়। দেশের অর্থনীতিসহ সার্বিক বিবেচনায় পানির কোন বিকল্প নেই। যত দ্রুতসম্ভব এ সমস্যার সমাধান করা জাতীয় স্বার্থেই জরুরি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন