শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নৈতিক অবক্ষয় রুখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, দেশে আশঙ্কাজনক হারে বিবাহ-বিচ্ছেদ বাড়ছে। অল্প শিক্ষিত কম শিক্ষিতরাই শুধু নয়, উচ্চবিত্ত শিক্ষিত পরিবারগুলোতেও এ হার আশঙ্কাজনক। মনে করা হচ্ছে, সামাজিক অস্থিরতা প্রগতিশীলতার নামে নারী স্বাধীনতা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক-ব্লগ-টুইটারে আসক্তির পর পুরুষের প্রতি নারীর আসক্তি, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বসহ নানা কারণে বিচ্ছেদ ঘটছে। সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর মেহতাব খানম মনে করেন প্রথমত, মেয়েরা অগের চেয়ে বেশি শিক্ষিত হচ্ছে। তারা এখন সচেতন। মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য না করে ডিভোর্সের পথ বেছে নিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মোবাইল কোম্পানীগুলোর নানা সহজলভ্য অফার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ফেসবুক এবং পর্নোগ্রাফির মতো সহজলভ্য উপাদানে আকৃষ্ট হয়ে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা হারাচ্ছে। ফলে বিয়ের মতো সুদৃঢ় সম্পর্ক এবং নৈতিক বিষয়টি ছিন্ন করতে একটু দ্বিধা করছে না।
পরিবার গড়ে ওঠার প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে বিবাহ। বিবাহ একটি শরিয়ত অনুমোদিত বৈধ সম্পর্কের  নাম। পৃথিবীর সবখানেই বিবাহ প্রথার চল রয়েছে। আমাদের সমাজে বিবাহ একটি ঐতিহ্যগত প্রথা বা রীতি। বিবাহ-বিচ্ছেদ মূলত একটি বৈধ পদ্ধতি। শরিয়তের বিধানমতে এটিকে নিন্দিত বৈধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কোন কারণে বিয়ে টিকিয়ে রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে শরিয়তের বিধানমতে নির্দিষ্ট নিয়মে বিচ্ছেদের বিধান রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, সমাজে বিয়ের মূলচেতনাতেই আঘাত এসেছে। ইসলামে বিয়েতে সর্বপ্রকার যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে, সমাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যৌতুক যেন বিয়ের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। বিয়ের ক্ষেত্রে সাবালকদের মতের গুরুত্ব ইসলামে অনুমোদিত হলেও প্রকৃত বিবেচনায় অভিভাবকদের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। বাস্তবে এখন দেখা যাচ্ছে কি উচ্চবিত্ত কি নিম্নবিত্ত সর্বত্রই এখন যেন বিয়ের ব্যাপারে অভিভাবকরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। অভিভাবকদের ইচ্ছার আগেই সন্তানরা নিজেরাই যেন ব্যাপারটি সম্পন্ন করছে। ফলে বিয়ের বেলায় যেসব বিষয়ে নজর দেয়া গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোতে যথেষ্ট সতর্কতার সাথে নজর না দেয়ার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হিসেবে একসময় বিচ্ছেদ স্থান করে নেয়। তথাকথিত ‘ভালোবাসার’ বিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক সময়ে বিষিয়ে ওঠে। ফলে চূড়ান্ত পরিণতি বিচ্ছেদেই সমাপ্ত হয়। একধরনের বঞ্চনা বা বৈষম্য বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে কোন কোন ক্ষেত্রে বিবেচিত। তবে এসবের সাথে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার সম্পর্ক কতটা তা বলা প্রকৃতই কষ্টকর। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে মহৎ ও উদার করে। স্ত্রীর উপর শারীরিকসহ যেকোন ধরনের নির্যাতন কোন সভ্য সমাজে করা হয় না। একটি সুশিক্ষিত ঐতিহ্যবাহী পরিবারে এধরনের কালচার খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানেই মূলত বিয়ের ক্ষেত্রে যে সব যোগ্যতার বিষয়টি বলা হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্য শিক্ষার বহিরাবরণ দেখে সবকিছু বোঝা যায় না। ফলে বিয়ের পর যখন মোহ ভঙ্গ হয় তখন বিচ্ছেদ ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। বিচ্ছেদের জন্য সবক্ষেত্রে এককভাবে মহিলাদের দায়ী করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। পুরুষের অবৈধ সম্পর্কও এক পর্যায়ে নারীকে জীবন বাঁচাতে বিচ্ছেদের দিকেই যেতে হয়। শরিয়তের বিধানমতে, বিচ্ছেদের অধিকার একমাত্র পুরুষের হলেও প্রচলিত আইনে এ অধিকার নারীরও রয়েছে। মূলত যেকোন কারণেই বিচ্ছেদ হোক না কেন তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে সন্তানের উপর। বিচ্ছেদের ভয়াবহতার শিকার হচ্ছে আগামী প্রজন্ম। এরা এর জন্য দায়ী না হলেও তারা বেড়ে উঠছে ভালোবাসা, স্নেহ দয়ামায়াহীন এক পরিবেশে। এটি সমাজ বাস্তবতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
প্রকৃত বিচেনাতে সমাজে নৈতিকতার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং তার অনুসরণ না থাকাতেই সমাজে যেসব বিশৃঙ্খলা স্থান করে নিয়েছে বিচ্ছেদ এর মধ্যে অন্যতম। এক সময়ে প্রগতিশীলতার নামে যারা কথিত ভালোবাসাকে প্রগতির অংশ বলে মনে করতেন, সেসব পরিবারগুলো তাদের সন্তানের বেলায় এখন অত্যন্ত সতর্ক। সার্বিক মনিটরিং করা হচ্ছে যাতে ওই ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়। একথা অস্বীকার করা যাবে না তথ্য-প্রযুক্তির অবারিত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে সমাজে অবৈধ যৌনাচারের যে যথেচ্ছার বিস্তার ঘটেছে তার কুপ্রভাব অনেক ক্ষেত্রে দাম্পত্য জীবনেও পড়ছে। এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না, একদিকে যেমনি বিচ্ছেদ বাড়ছে, তেমনি আবার অনুশোচনাকারীর সংখ্যাও বাড়ছে। সবমিলে কথা হচ্ছে, সমাজ ভাঙছে  নেতিবাচকতায়। এর কারণ সমাজের অভ্যন্তরেই রয়েছে। সমাজে বিবাহ-বিচ্ছেদ কমাতে হলে প্রাথমিকভাবে বিবাহের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নজর দিতে হবে। বিবাহকে কঠিন করা যাবে না। সমাজ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যৌতুক তুলে দিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নিয়মানুযায়ী বিবাহ পুরুষই করে, সুতরাং সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে তাকেই সহিষ্ণু ও সহমর্মী হতে হবে। জীবনযুদ্ধের সকল ব্যস্তবতা সত্ত্বেও পরিবারকে সময় দেয়া অত্যন্ত জরুরি। পরিবারের প্রতি বিশেষ করে সন্তানদের প্রতি কার্যকর মনিটরিং অপরিহার্য। বিয়ের ব্যাপারটিকে নিছক যৌনতার দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, বরং সমাজ গঠনের প্রাথমিক ইউনিট হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি পরিবার ভাঙা মানেই একটি বংশধর ভেঙে যাওয়া। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিচ্ছেদকে উস্কে না দিয়ে পরিবার পরিচালনে আগ্রহী করে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মনে রাখতে হবে, একটি সুস্থ নিরাপদ পরিবার গঠন করার অর্থই হলো একটি সুখীসমৃদ্ধ দেশ গঠনের প্রাথমিক দায়িত্ব পালন। একে সামাজিক আন্দালনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে সবাই মিলে সংশোধনের চেষ্টা করলে এর থেকে বেরিয়ে আসা মোটেও কষ্টকর নয়। বিয়ের ব্যাপারে যথাযথ ধর্মীয় অনুশাসন মানা এবং তার চর্চা নিখুঁতভাবে করা একান্ত অপরিহার্য। তাহলে বিচ্ছেদের বেদনাদায়ক পরিণতির অনেকটা সমাপ্তি সম্ভব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন