ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শংকর আজ ঢাকা আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন নয়াদিল্লী সফরের তারিখ, আলোচ্যসূচী এবং সম্ভাব্য চুক্তির বিষয় চূড়ান্ত করাই তার এ সফরের লক্ষ্য বলে জানা গেছে। এর আগে দু’দফায় প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লী সফরের তারিখ পেছানো হয়েছে। এবার সেটি চূড়ান্ত হবে এবং ধারণা করা হচ্ছে, এপ্রিল মাসে এ সফর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জয়শংকর তার সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে তার বৈঠক হবে। এসব বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। ভারতের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারসহ অন্তত দুই ডজন চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয় চূড়ান্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্র মতে, বন্দর ব্যবহার সংক্রান্ত আলোচনা ও চুক্তির পাশাপাশি নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আলোচনা ও চুক্তির বিষয়টি আলাদাভাবে প্রাধান্য পাবে। কানেকটিভিটি ও জ্বালানি ক্ষেত্রে সহযোগিতাও যথোচিত গুরুত্ব লাভ করবে। তবে অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টনসহ ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি সম্পর্কে কোনো আলোচনা, সমঝোতা বা চুক্তির সম্ভাবনা নেই। বাণিজ্য বৈষম্য নিরসন, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা এবং অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান বন্ধে আলোচনা-সমাঝোতা হবে কিনা, সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি। সন্দেহ নেই, ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে জয় শংকরের এ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লী সফরও তার জন্য খুবই তাৎপর্যবহ ও গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের ৬-৭ জুন বাংলাদেশ সফর করেন। সফর শেষে ৬০ দফার যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। সঙ্গত কারণেই জয়শংকরের সফর কেন্দ্রিক আলোচনায় ওই ৬০ দফা বাস্তবায়ন বিষয়ে বিশেষত তার অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা হবে। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর হবে ফিরতি সফর। সে কারণে ৬০ দফার অগ্রগতি বিষয়ক আলোচনা অনিবার্যভাবেই গুরুত্ব লাভ করবে। নরেন্দ্র মোদির সফরের সময়ে ভারতের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের ব্যাপারে যে সমঝোতা হয়েছিল, ভারত চাইছে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী সফরের সময় সে সম্পর্কে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে। এ নিয়ে আলোচনা ইতোমধ্যে অনেক এগিয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের অকাঠামো, যন্ত্রপাতি, লোকবল, বন্দর চ্যানেলের নব্যতা ইত্যাদির যা অবস্থা তাতে ভারতকে বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেয়া সম্ভব নয়। দিলে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের আশংকা। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, গত বছরের ১৪-১৫ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেন। সফরের সময় দু’দেশ একে অপরকে কৌশলগত মিত্র হিসাবে ঘোষণা করে। দু’দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভিত্তিক সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা হয়। ২৭টি ডিলে চীন বাংলাদেশকে ২৫ বিলিয়ন ডলার দেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সামরিক খাতে চীনের বিপুল সহযোগিতার কথা সকলেরই জানা। বাংলাদেশ চীন থেকে দু’টি সাবমেরিনও কিনেছে। বাংলাদেশ ও চীনের এই ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক ও সহযোগিতাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না ভারত। এর বিপরীতে ভারতও বাংলাদেশে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা দিয়ে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ উপলক্ষেই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর গত ৩০ নভেম্বর- ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা করেন। জানা যায়, ভারত এখনই চাইছে নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডকে জাহাজ, সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করতে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে আগ্রহী ভারত। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিয়ে চীন কিংবা ভারতের সঙ্গে এধরনের কোনো প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য ঠিক হবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ আঞ্চলিক কানেকটিভিটি অবশ্যই চায়। এটা চায় সংশ্লিষ্ট সব দেশের স্বার্থে। কিন্তু এই কানেকটিভিটির লক্ষ্য যদি হয় ভারতকে করিডোর ও ট্রানজিট দেয়া, তাহলে সেটা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এও বলা আবশ্যক, বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হলেও এক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভরতা কাম্য নয়। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া বা চুক্তি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে যথেষ্ট সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।
ক’দিন আগে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার এক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সহযোগিতার সুবাদে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। বাস্তবে দেখা যায়, এই সহযোগিতা অনেকটাই একতরফা। বাংলাদেশ প্রায় বিনা প্রশ্নে ও বিনা দ্বিধায় ভারতকে সহযোগিতা দিচ্ছে। বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে কোনো সহযোগিতাই করছে না। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার ব্যাপারে ভারত নীরব। তার একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের নদ-নদী মরে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অন্তত ৬শ’ নদী অস্তিত্ব হারিয়েছে। পানির অভাবে বাংলাদেশের জনজীবন, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, উৎপাদন ব্যবস্থা সব কিছুই মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তির কোনো খবর নেই। চুক্তি হবে, এমন আশা নেই। সীমান্তে বিএসএফ পাখির মতো বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা করছে। কোনো প্রতিকার নেই। বাণিজ্য বৈষম্য দিনকে দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের পণ্য শুল্ক ও অশুল্ক বাধার কারণে ভারতের বাজারে ঢুকতে পারছে না। সম্প্রতি পাট রফতানী ঠেকিয়ে দিতে এন্টি ডাম্পিং ট্যাক্স আরোপ করেছে ভারত। সীমান্ত পথে অবলীলায় অস্ত্র ও মাদক ঢুকছে বাংলাদেশে। ঠেকানোর কোনো পদক্ষেপ ভারত নিচ্ছে না। বলা বাহুল্য, সম্পর্ক ও সহযোগিতা একমুখী হতে পারে না। নেবো এবং দেবো, সম্পর্ক ও সহযোগিতার এটাই ভিত্তি। না হলে সম্পর্ক ও সহযোগিতা দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই হয় না। এটা দুই দেশকে বিশেষ করে ভারতকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। ভারতের সঙ্গে আলোচনা, সমঝোতা, চুক্তি যাই হোক, বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বা উচ্চ পর্যায়ের যে কোনো বৈঠকে বাংলাদেশকে তার নিজস্ব এজেন্ডা আলোচনায় এনে জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে সমঝোতা ও চুক্তির চেষ্টা করতে হবে। জয়শংকরের সঙ্গে আলোচনা এবং প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লী সফরের সময় দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হবে বলে আমরা আশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন