শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সাদা পোশাকে গ্রেফতার অবিলম্বে বন্ধ করা হোক

| প্রকাশের সময় : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক ইনকিলাবের প্রধান সংবাদ হিসেবে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে সেটি সত্যিই আতঙ্কজনক। খবরে বলা হয়েছে, মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্ক নিয়ে ফেরারি জীবনযাপন করছে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী। কারাবন্দী, জামিনে মুক্ত ও ফেরারি নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে। নিঃশব্দে গ্রেফতার চলছে। দেশজুড়েই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-ভীতি। গত দুই মাসে এর মাত্রা বেড়েছে। যোগ হয়েছে সাদা পোশাক আতঙ্ক। রাত-বিরাতে সাদা পোশাকে বিরোধী নেতাদের তুলে নিয়ে সুবিধাজনক সময়ে পুরনো বা নতুন মামলা কিংবা মাদকদ্রব্যসহ গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। একই সাথে দিবানিশি রাজনীতিকদের বাসা-বাড়ি ও বাণিজ্যালয়ে চালানো হচ্ছে তল্লাশি। এদিকে এক মামলায় জামিন মিললেও বাতিল হচ্ছে একাধিক মামলার জামিন। আবার জামিনে মুক্তি পেয়েও স্বস্তি নেই। সহায়-সম্পদ বিক্রি করে হলেও মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হচ্ছে যাতে গুম, নতুন মামলার আসামি কিংবা পুরনো মামলার চার্জশিটের অন্তর্ভুক্ত করা না হয়। এই ধরনের খবর পড়ার পর স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, দেশে কি আইনের শাসন আছে?  প্রশ্নটি এই জন্যই ওঠে যে, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, সাদা পোশাকে গ্রেফতার ইত্যাদি পুলিশি কার্যক্রম দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০০৩ সালে গ্রেফতার রিমা- ইত্যাদি সম্পর্কে বিচারপতি হামিদুল হক পনের দফা সম্বলিত   একটি নির্দেশনামা জারি করেন। অনেক আলাপ-আলোচনা এবং দীর্ঘ শুনানির পর গত বছর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কতিপয় যোগ-বিয়োগসহ ঐ পনের দফা বহাল রাখেন। ঐ পনের দফার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কাউকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করা যাবে না। সাদা পোশাকে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে না। পোশাক পরে পুলিশকে গ্রেফতার অভিযানে নামতে হবে এবং কাউকে গ্রেফতার করার সময় পুলিশ তার বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ করবে। রিমা-ের নামে কাউকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা যাবে না। কোনো অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে একটি কাঁচের ঘেরা টোপে জিজ্ঞাসা করতে হবে। কাঁচের এই ঘেরাটোপটি অত্যন্ত স্বচ্ছ হতে হবে। প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আসামির আইনজীবী পাশে থাকতে পারবেন। জিজ্ঞাসাবাদের আগে রোগীর মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে ডাক্তারি সার্টিফিকেট থাকতে হবে। এই ধরনের আরো অনেক নির্দেশনা বিচারপতি হামিদুল হকের ঐ পনের দফায় রয়েছে। এই পনের দফা নির্দেশনাকে সরকার বা অন্যান্য সংস্থার প্রতি জুডিশিয়াল ডাইরেক্টিভ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এখন সেটি হামিদুল হকের নির্দেশনা আকারে আর নেই, এখন বরং সেটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা হিসেবে সরকারের তথা সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির ওপর বাধ্যতামূলক।
কিন্তু এদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং অপরাধ চিত্র দেখে মনে হচ্ছে যে, এগুলো সব প্রবাদ প্রবচনের কথার কথা। একটি প্রবাদ বাক্যে বলা হয়েছে, “কাজীর গুরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই”। সুপ্রিম কোর্টের এসব নির্দেশনাও এখন কাজীর গরুর মতো পুস্তকে আছে, কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নাই। তাই যদি না হবে তাহলে ২০১৬ পার হয়ে এই ২০১৭ তেও সাদা পোশাকে অপহরণ, নিখোঁজ এবং লাশ হওয়ার খবর পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে কেন? এই তো গত ডিসেম্বরে নাটোরে ৩ যুবক নিখোঁজ হয়। তাদের লাশ মিললো দিনাজপুরে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, গত ৪ বছরে গুম হয়েছে ২৩০ জন। সেদিন পানির নিচ থেকে একটি দামী মোটরগাড়ী উদ্ধার করা হয়েছে। সেই গাড়ির মালিককে কিছু দিন আগে গুম করা হয়েছে। আজও তার খবর নাই। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাই শুধু নন, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ নিয়মিত গুম হচ্ছে, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার হচ্ছে, অপহৃত হচ্ছে এবং এক সময় লাশ হয়ে ফিরে আসছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুম হওয়া ব্যক্তির লাশ আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সিলেটের ইলিয়াস আলী একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা। ড্রাইভারসহ তিনি গুম হয়েছেন কয়েক বছর আগে। আজ পর্যন্ত তার কোনো খবর নাই। একই অবস্থা চৌধুরী আলমের ক্ষেত্রেও। তার ইন্দিরা রোডের বাড়ী থেকে সাদা পোশাকধারীরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। কয়েক বছর অতিক্রান্ত হলো, আজও তার কোনো খবর নাই।
অজ্ঞাত বা রহস্যজনকভাবে নিখোঁজদের অনেকের পরিবারের পক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার অভিযোগ করা হলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথমে অস্বীকার করা হয়। তারপর স্বীকার করলেও উদ্ধারের কোন কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না, যদিও নিখোঁজ ও ভিকটিমদের নিরাপত্তা এবং খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের তথা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। নিখোঁজ বা গুম হওয়া মানুষদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের, এই মতামত ব্যক্ত করে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকগণ এ বিষয়ে একটি বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করা হচ্ছে এবং নিখোঁজদের পরিবারগুলো বছরের পর বছর ধরে স্বজনের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় দিন গুনছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট বার বার ধর্ণা দিলেও তারা কিছুই করছে না। দায়িত্বশীল মহল মনে করে যে, বাংলাদেশকে যদি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে হয়, যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলে অবিলম্বে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, সাদা পোশাকে আটক এবং গুম ও খুনের অবসান ঘটাতে হবে। এব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো অজুহাত জনগণের কাছে গ্রহণ যোগ্য হবে না। 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন