শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা রুখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গত মঙ্গলবার নরসিংদীর আলোকবালির চরে রুবেল নামের এক ব্যক্তি তার তিন শিশু ভাইবোনকে গলাটিপে হত্যা করেছে এবং বড় ভাইকে কুপিয়ে জখম করেছে। কেন সে এটা করেছে, তার কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। বুধবার কক্সবাজারের পোকখালির পূর্ব গোমতলিতে রশিদ নামের এক ব্যক্তি ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে বড় ভাইকে এবং তার আড়াই বছরের শিশু সন্তানকে। আগুনে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়েছে ভাইয়ের স্ত্রী ও মা। কেন রশিদ এই বর্বর কান্ড করেছে তারও কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি। নরসিংদী ও কক্সবাজারের এই দুটি মর্মান্তিক ও নৃশংস হত্যাকান্ড পারিবারিক পর্যায়ে সংঘটিত হয়েছে এবং এ রকম ঘটনা দেশে প্রায়ই ঘটছে। এর বাইরেও নানাভাবে হত্যাকান্ড ঘটছে। এসব হত্যাকান্ডের ঘটনায় অন্যান্যের সঙ্গে বিশেষভাবে শিকার হচ্ছে শিশুরা। শিশুরা নিষ্পাপ এবং কারো সাথে কোনো শত্রুতা না থাকার কারণে তারা হত্যাকান্ড ও শারীরিক নির্যাতন থেকে নিরাপদ থাকবে, এটাই মনে করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিশুরাই অধিক সংখ্যায় হত্যা-নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে। সামান্য এক ভরি সোনার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে খুন করা হয়েছে দুই শিশুকে। শিশুদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ও হত্যা এখন অতিসাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পারিবারিক অশান্তি, বিরোধ ও শত্রুতাবশত শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে অবিরাম। শিশুর প্রতি এই নিষ্ঠুরতা নৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবনতিরই পরিচয় দেয়।
চলতি বছরের প্রথম দেড়মাসে ৪৫ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জন নিহত হয়েছে বাবা-মা’র হাতে। এর অর্থ প্রতিদিন গড়ে একটি শিশু খুন হয়েছে। শিশুরা কেবল হত্যাই নয়, ধর্ষণসহ নানাবিধ অত্যাচার ও নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছে। দুটি সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর ৩ শতাধিক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যাদের অর্ধেকের বয়স ১২ বছরের নীচে। এছাড়া প্রায়ই শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটছে। চলতি মাসে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ধরা পড়া একটি অপহরক চক্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে তারা ১৭টি শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। শিশু অধিকার ফোরামের মতে, অপহরণের পর হত্যা, পিটিয়ে হত্যা, রাজনৈতিক বা পারিবারিক দ্ব›দ্ব, খেলা নিয়ে সংঘর্ষ, জমিজমা বা অন্যান্য বিরোধের জের ও যৌতুকের কারণসহ বিভিন্ন কারণে শিশুরা খুন হচ্ছে। আরও একটি উদ্বেগজনক তথ্য হলো, এখন শিশুদের হাতেও শিশুরা খুন হচ্ছে। জানুয়ারি মাসের শুরুতে উত্তরায় এক স্কুল ছাত্র খুন হয়। খুনের দায়ে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের একজনের বয়স ১৩ ও অন্য জনের বয়স ১৬ বছর। জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। ঢাকাতে নাকি এরকম অর্ধশত গ্যাং আছে যারা হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। দেখা যাচ্ছে, শিশুরা এখন সম্পূর্ণ অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। কে কখন যে নৃশংসভাবে খুন হবে, অপহৃত হবে, নির্যাতিত ও আহত হবে, তার কোনো ঠিক নেই। এ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হয়।
দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি অনেকদিন ধরেই নাজুক। নাগরিক নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। খুন, গুম, অপহরণ, বন্দুক যুদ্ধ, সন্ত্রাস, সংঘর্ষ, দুর্ঘটনা ইত্যাদি এত বেড়েছে যে, কারো পক্ষেই নিজেকে নিরাপদ ভাবা সম্ভব নয়। শিশু হত্যা বা শিশুর প্রতি সহিংসতা এই পরিস্থিতির বাইরের কিছু নয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিরই এটা অপরিহার্য-অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। পর্যবেক্ষক- বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশে নৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ব্যাপক ধস সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতা, লোভ, ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা এবং দুর্বার ভোগেচ্ছা মানুষকে মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিক শাসন থেকে দূরে সরিয়ে নিরালম্ব করে দিয়েছে বা দিচ্ছে। এমতাবস্থায়, সর্বক্ষেত্রেই যথেচ্ছাচার বেড়ে গেছে। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রত্যাবর্তন এবং একই সঙ্গে কঠোর আইনী শাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, সন্ত্রাসসহ অপরাধ সংকোচনের কোনো উপায় নেই। শিশুদের প্রতি যে নিষ্ঠুরতা এখন চলছে, তা ঠেকাতে হলে তাদের প্রতি আলাদা নজর দিতে হবে। অভিভাবকদের যেমন আরও সতর্ক ও সাবধান হতে হবে, তেমনি রাষ্ট্রকে শিশু অধিকার সংরক্ষণে যথাযথ গুরুত্বসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা অবুঝ, মাসুম, শারীরিকভাবে নাজুক, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেই তাদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। শিশু হত্যা, শিশু নির্যাতন, শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন