সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষা যে কর্মক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। বহু দিন ধরেই শিক্ষাবিদরা এ কথা বলে আসছেন এবং তারা মেধাভিত্তিক শিক্ষাÑ যা কর্মক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত তার ওপর জোর দিয়ে আসছেন। এ কথাই পুনরায় ধ্বনিত হলো শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কণ্ঠে। গত শনিবার তিনি স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট (স্টেপ) কর্তৃক আয়োজিত জাতীয় স্কিলস কম্পিটিশন-২০১৬ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, দক্ষতাবিহীন সনদভিত্তিক শিক্ষা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতির জন্য বোঝা তৈরি করে। তিনি বলেন, শিক্ষা হবে দক্ষতামুখী। যুগোপযোগী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা-প্রশিক্ষণই জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। কারিগরিই হবে শিক্ষার অগ্রাধিকার। সরকার পর্যায়ক্রমে শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেবে। শিক্ষামন্ত্রীর এ কথা অত্যন্ত সময়োপযোগী। তার এ কথার পাশাপাশি এটাও বলা দরকার, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও তার মান নিয়ে বহু দিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে। এ নিয়ে শিক্ষাবিদদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ফলে এ শিক্ষাব্যবস্থা এবং এর মানের দিকটিও উন্নত করা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে এবং সার্টিফিকেটধারীতে পরিণত না হয়।
যে শিক্ষায় কেবল সার্টিফিকেটই অর্জিত হয়, বাস্তবে কাজে লাগে নাÑ এমন শিক্ষা থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। যথাযথ যোগ্যতার অভাবে সার্টিফিকেটধারী শিক্ষার্থী যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না পারে, তখন তার হতাশার অন্ত থাকে না। এ ধরনের শিক্ষার্থী শুধু পরিবারই নয়, জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বেকারত্বের হারকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ করে তোলে। এর জন্য শিক্ষার্থী যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা। এর পাশাপাশি শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করার অপসংস্কৃতিও প্রকৃত শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে রয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, হাত বাড়ালেই সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। অর্থ খরচ করলে যে কেউ উচ্চতর শিক্ষার সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে ডক্টরেট ডিগ্রি পর্যন্ত অবলীলায় পেতে পারে। এ ধরনের সার্টিফিকেট বাণিজ্য দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। বিশেষ করে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, তাদের অধিকাংশই প্রকৃত শিক্ষার ধার না ধেরে সার্টিফিকেট ব্যবসার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের না আছে নিজস্ব ক্যাম্পাস, না আছে শিক্ষক এবং না আছে শিক্ষা লাভের যথাযথ সুযোগ-সুবিধা। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, এসব নামকাওয়াস্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারও হয়ে যাচ্ছে। কোনো ধরনের লেখাপড়া না করে যখন এসব শিক্ষার্থী পাস করে বের হয়, তখন কর্মক্ষেত্রে গিয়ে তারা নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। অনেকে চাকরির ইন্টারভিউটুকু ঠিকমতো মোকাবেলা করতে পারে না। আবার যারা কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন, তাদের মধ্যেও অনেকে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থের বিনিময়ে ডক্টরেট ডিগ্রির সার্টিফিকেট কিনে নেন। শুধু নামের আগে ডক্টর শব্দটি বসানোর জন্য। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও অনেকে এমন সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরি করছেন। তাদের সার্টিফিকেটের জোর থাকলেও কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে তারা চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। এটা জাতির জন্য ক্ষতিকর তো বটেই, লজ্জারও। এ ধরনের কর্মকর্তারাই প্রশাসনিক দক্ষতা প্রদর্শন ও গতিশীল করার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সার্টিফিকেট ব্যবসার এ প্রবণতা বহু দিন ধরেই চলছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সার্টিফিকেট ব্যবসার জন্য ধরাও পড়েছে। তবে বেশিরভাগই ধরাছোঁয়ার বইরে রয়ে যাচ্ছে। আমরা এমনও জানি, নীলক্ষেতসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় উচ্চ শিক্ষার রেডিমেড সার্টিফিকেট কিনতে পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়লেও, আইনের ফাঁক-ফোকর গলে তারা বের হয়ে পুনরায় একই কাজ শুরু করে। এ ধরনের জাল সার্টিফিকেট ব্যবসায়ীদের যেমন নির্মূল করা যাচ্ছে না, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বানিয়ে যারা পড়াশোনা বাদেই সার্টিফিকেট দিচ্ছে, তাদেরও নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। এতে একদিকে জাতির মেরুদ- হিসেবে পরিচিত শিক্ষাব্যবস্থা যেমন ধসে পড়ছে, তেমনি অপূরণীয় ক্ষতিও সাধিত হচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার বর্তমান বাস্তবতা উপলব্ধি করে যথার্থ বক্তব্য পেশ করেছেন। তিনি শিক্ষাকে বাস্তব ও কর্মমুখী করে তোলার জন্য কারিগরি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলেছেন। ইতোমধ্যে এ খাতকে পর্যায়ক্রমে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা মনে করি, এই পদক্ষেপের পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠান সার্টিফিকেট বাণিজ্যের সাথে জড়িত, সেগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। যে কোনো উপায়ে এ ধরনের সার্টিফিকেটসর্বস্বরা যদি প্রশাসনসহ অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে, তবে তা দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে ভয়াবহ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। যারা প্রকৃত সার্টিফিকেটধারী তাদের মধ্যে চরম হতাশা দেখা দেবে। এ হতাশা পুরো জাতির ওপর চেপে বসবে। আমরা আশা করব, শিক্ষাকে বাস্তব ও কর্মমুখী করে তুলতে সরকার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। নকল সার্টিফিকেটের উৎস বন্ধ করার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। পাশাপাশি নকল সার্টিফিকেট ও সার্টিফিকেটসর্বস্বদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন