মহেশখালির সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের আওতাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি একটি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ডিপো নির্মাণের প্রস্তাব করেছে বলে জানা গেছে। এ জন্য ইস্টার্ন রিফাইনারি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৯১ একর জমি ইজারা চেয়েছে বলে গতকাল একটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বন বিভাগের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে বলা হয়েছে, এ ধরনের প্রস্তাব অনুমোদন পেলে মহেশখালির সংরক্ষিত বনের প্রায় ২৫ হাজার গাছ কাটা পড়বে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশের ক্রমবিলীয়মান বনভূমিকে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মহেশখালির মতো সামুদ্রিক দ্বীপটিতে ভূমিক্ষয়, মাটি, পানিসহ পরিবেশদূষণের ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যগত হুমকি মারাত্মকভাবে দেখা দিতে পারে। তেলের ডিপোর মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর স্থাপনা নির্মিত হলে মহেশখালি বনাঞ্চলটি তেল নিঃসরণসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনাজনিত অগ্নিকা-ের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। দেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সমুদ্রবেষ্টিত জেলা কক্সবাজারের গুরুত্ব অনেক বেশি। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক চেহারাই পাল্টে দেয়া সম্ভব। কিন্তু অশুভ শক্তির দখলবাজির কারণে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদরাজি ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময়ে কক্সবাজারের সংরক্ষিত হাজার হাজার একর বনভূমি স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের হাতে বেদখল হয়ে যাওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সংরক্ষিত বনভূমিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স’মিলে কাটা হচ্ছে বনের গাছ। এমনকি বনভূমি দখল করে অবৈধভাবে গড়ে তোলা ইটভাটায়ও পোড়ানো হচ্ছে সংরক্ষিত বনের গাছ।
পরিবেশগত ভারসাম্য এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত রাখতে একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সেখানে বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য পরিমাণের অর্ধেক বনভূমি রয়েছে। দখলবাজি ও দূষণের কারণে তাও দ্রুত কমে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় আন্তর্জাতিকভাবেই দেশের অভ্যন্তরভাগে তো বটেই উপকূলীয় বনভূমি ও জলাভূমি সংরক্ষণের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, মৌসুমি ঝড়-বৃষ্টির গ্রাস থেকে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, মহেশখালি, সেন্টমার্টিনস ও শাহপরীর দ্বীপের মতো সমুদ্রোপকূলীয় প্রান্তিক জনপদের ভূমিরক্ষায় বনভূমি এবং উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা। বনবিভাগের একশ্রেণীর কর্মকর্তার দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা, অবহেলা অথবা বনদস্যুদের সাথে যোগসাজশের কারণে এসব অঞ্চলের সবুজ বেষ্টনী এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছপালা ব্যাপক হারে ধ্বংস হওয়ায় ইতোমধ্যেই হাজার হাজার একর ভূমি সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। বনভূমি ও গাছপালা সংরক্ষণ অথবা উপকলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের মতো কোনো কার্যকর উদ্যোগই ঠিকমতো নিতে পারেনি সরকারের বনবিভাগ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এসব বিভাগের দায়িত্বহীন ভূমিকার কারণে যে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তার দায় সরকার এড়াতে পারে না।
সুন্দরবনের অভ্যন্তরে দেশের বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন ধ্বংসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ন এবং শিল্পায়নের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে হলে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র বা তেলের ডিপো নির্মাণে বিরোধিতা করার কোনো কারণ নেই। তবে শত শত একর জমিতে এসব স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে আমরা কেন সুন্দরবন বা মহেশখালির সংরক্ষিত বনাঞ্চলকেই বেছে নেব? বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কেন বনভূমি ধ্বংস ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা আছে এমন প্রকল্প গ্রহণ করছেন? মহেশখালিতে তেলের ডিপো নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি। এ বিষয়ে পার্শ¦প্রতিক্রিয়া এবং ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিদ্যমান আইন অনুসারে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি ইজারা দিতে হলে সরকারপ্রধানের অনুমোদন লাগে। তা ছাড়া এ বিষয়ে উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের কার্যপত্রে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানা যায়। মহেশখালির সংরক্ষিত বনে যে জমি ইজারার জন্য চাওয়া হয়েছে সেখানে অনেক প্রজাতির গাছপালা এবং অনেক বিরল প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে। হাজার হাজার গাছ কর্তন করে পুরো বনাঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্টের উদ্যোগ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো বিরত থাকবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে পরিবেশগতভাবে নিরাপদ স্থানে তেলের ডিপো প্রতিষ্ঠার বিকল্প উদ্যোগ নিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তই জানাবেন বলে আমরা আশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন