শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

স্বাভাবিক বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে চাঞ্চল্যকর চার শিশু হত্যার অন্যতম সন্দেহভাজন ব্যক্তি বাচ্চু মিয়া র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার ভোরে জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেওরগাছ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে গত বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুন মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন অন্যতম প্রধান আসামী সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদকে আদালতে হাজির না করায় ওই দিন সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। আইন অনুযায়ী কোনো আসামীর অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য গ্রহণ করার কোনো বিধান না থাকায়, ওই দিন সাক্ষ্যগ্রহণ করা যায়নি। এ নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। কেন তারেক সাঈদকে আদালতে হাজির করা হয়নি, এর কারণ সম্পর্কে পুলিশ আদালতে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। ফলে আদালত ২৯ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করে যে কোনোভাবে হোক তাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন। এমনকি তিনি অসুস্থ থাকলেও অ্যাম্বুলেন্সে করে হাজির করতে বলা হয়েছে। উল্লেখিত দু’টি ঘটনায়, আইনজ্ঞরা বিচার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। এর কারণ, একটি ঘটনায় বিচার শুরুর আগেই সন্দেহভাজন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে, অন্যটিতে আসামীকে আদালতে হাজির করা হয়নি। উভয় ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়া ক্ষুণœ হওয়ার আলামত রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া বা সুযোগ সৃষ্টি করা কোনো সভ্য দেশে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রত্যেকেই চায়, যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে আইনের শাসন ও সুশাসন নিশ্চিত করা হবে। এক্ষেত্রে অপরাধীর প্রতি আইনবহির্ভূত ও অস্বাভাবিক আচরণ এবং অনুকম্পা প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই। এতে তাড়াহুড়ো করা বা কালক্ষেপণও উচিত নয়। কথায় আছে, ‘জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বারিড’। একইভাবে এ কথাও প্রচলিত, ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড।’ অর্থাৎ বিচারের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো ও ঢিলেমি দুটোই বর্জনীয়। এর ব্যত্যয় ঘটলেই বিচার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরাধীর অপরাধের সুষ্ঠু বিচার যেমন বিঘিœত হয়, তেমনি বিচারপ্রার্থীরও সুষ্ঠু বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, আমাদের দেশে এ ধরনের প্রবণতা বহমান রয়েছে। প্রায়ই অপরাধে অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজনদের কথিত বন্দুকযুদ্ধের শিকার হয়ে নিহত হতে দেখা যায়। আবার প্রভাবশালী সন্দেহভাজন হলে তাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়ার নানা উপায় খোঁজা থেকে শুরু করে টালবাহানা পরিদৃষ্ট হয়। বিশেষ করে চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে তা লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছে। এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বিচারিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার এক ধরনের চেষ্টা থাকে। অথচ সচেতন মানুষ চায়, অপরাধী যত বড় অপরাধই করুক না কেন, তাকে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হোক। বিচারের আগেই কথিত বন্দুকযুদ্ধের শিকার হওয়া অথবা নানা পন্থায় অভিযুক্তকে বাঁচানোর অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া অবলম্বন কাক্সিক্ষত নয়। এ কথা সর্বজনবিদিত, নারায়ণগঞ্জের মর্মান্তিক সাত খুনের মামলার অন্যতম অভিযুক্ত তারেক সাঈদ। তিনি শুধু প্রভাবশালী র‌্যাব কর্মকর্তাই ছিলেন না, একজন মন্ত্রীর মেয়ের জামাইও। ফলে তার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করা অস্বাভাবিক নয়। ইতোমধ্যে এরকম কিছু কিছু ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন তাকে হাজির করা হয়নি। কেন হাজির করা হয়নি, তার যথাযথ ব্যাখ্যা পুলিশ দিতে পারেনি। আইনজ্ঞরা মনে করছেন, সাক্ষ্যগ্রহণের দিন অভিযুক্তকে হাজির না করার বিষয়টি বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় পর্যবসিত করার একটি কৌশল, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। অন্যদিকে পর্যবেক্ষকরা উদাহরণ দিয়ে বলেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে মাঝারি পর্যায়ের নেতাদের বিচার কার্যক্রমের ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া অত্যন্ত দ্রুত গতিতে শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসার একটি প্রবণতা রয়েছে। এর ফলে বিচারের ক্ষেত্রে দু’ধরনের প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সুশাসন ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে এ প্রবণতা অগ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। একইভাবে অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার ক্ষেত্রে অভিযুক্তের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়াকে আইনবিদরা ইতোমধ্যে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা মনে করেন, অপরাধী যত বড় অপরাধই করুক, তাকে আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে। হবিগঞ্জের চার শিশু হত্যার অন্যতম সন্দেহভাজনেরও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনাকে তারা বিচারপ্রক্রিয়ার জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন। সরকারি কৌঁসুলি ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এতে মামলার আইনি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে না।’ বাধাগ্রস্ত হোক বা না হোক, স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তের বিচার হলেও তো কোনো সমস্যা ছিল না। বরং এটাই হতো যথোপযুক্ত।
আইনের চোখে সকলেই সমান। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কে কত বড় ব্যক্তি, তা দেখে বিচার করা হয় না। এমনকি একজন আসামী খুন বা অন্য কোনো গুরুতর অপরাধ করে হাতেনাতে ধরা পড়লেও তার শাস্তি যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই হতে হয়। তাকে সাথে সাথে মেরে ফেলা হয় না। তারও আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমাদের দেশে আইনের এই স্বাভাবিক গতিধারা ব্যাহত হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তদন্তে শৈথিল্য ও চার্জশিট এমনভাবে দেয়া হয়, যাতে মামলাটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন না করার কারণে অনেকে রেহাই পেয়ে যায়। এ নিয়ে প্রায়শঃ আদালতে অসন্তোষও প্রকাশ করতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে মূল অভিযুক্তকেও চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয়। আবার পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি ও জনসাধারণের তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, বিচারিক কার্যক্রম বিলম্বিত করার নানা প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়, যাতে মামলাটি ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে। আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- যেমন চাই না, তেমনি বিচার প্রক্রিয়ার অস্বাভাবিক দ্রুতগতি ও শৈথিল্যও চাই না। আমরা চাই, আইনের যথাযথ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অপরাধী যেই হোক তার বিচার হোক। দেশে আইনের শাসন ও সুশাসন নিশ্চিতে আইনের স্বাভাবিক এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বনের বিকল্প নেই।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন