সারাদেশ পরিবহন ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়ে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের ভোগান্তির কোনো শেষ থাকে না। আগে থেকে কেউই ধারণা করেনি, হঠাৎ করেই গোটা দেশ এরকম অচলাবস্থায় পতিত হবে। রাজধানীর সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের এবং এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাজধানীতে যাত্রীবাহী পরিবহন বন্ধ থাকায় যাত্রীসাধারণের বিশেষত অফিসগামী, হাসপাতালগামী, ছাত্র-ছাত্রী, পরীক্ষার্থীসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষেরই ভোগান্তি চরমে উঠে। দেশের অন্যত্রও একই অবস্থা সৃষ্টি হয়। যাত্রীবাহী যানবাহনের অভাবে কেউই কোথাও যাতায়াত অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেকেই পথে-ঘাটে আটকে থাকে। জরুরি কাজ ও প্রয়োজনে কোথাও যেতে হলে রিকশাসহ অন্যান্য যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হয়। অন্যদিকে পণ্যবাহী পরিবহন বন্ধ থাকায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মালামাল পরিবহন বন্ধ থাকে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মালামাল নিয়ে যায়। অনুরূপভাবে বন্দরে মালামাল নিয়ে আসে। পরিবহন ধর্মঘটে এসব মালামাল আনা-নেয়া বন্ধ থাকে। স্থল বন্দরগুলোতে শত শত মালবোঝাই ট্রাক আটকে পড়ে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পণ্যবাহী যানও কোথাও যেতে পারে না। এর ফলে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েন। পচনশীল পণ্য নষ্ট হয়। দু’দিনের পরিবহন ধর্মঘটে চরম যাত্রী ভোগান্তি ছাড়াও অর্থনীতির যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। দেশজুড়ে কেমন করে এ ধরনের পরিবহন ধর্মঘট চলতে পারে, তা ভাবতেও বিস্মিত হতে হয়।
পরিবহন ধর্মঘটের সূচনা হয়েছিল মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করে। ২০১১ সালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে সাংবাদিক মিশুক মুনীর ও চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদসহ পাঁচজন নিহত হন। ওই মামলায় আদালত বাসচালক জামির হোসেনকে অবহেলা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর দায়ে এবং তার লাইসেন্স হালনাগাদ না থাকায়, বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট না থাকা ইত্যাদি কারণে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করে। এই রায়ের প্রতিবাদে প্রথমে চুয়াডাঙ্গায়, পরে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলায় এবং আরো পরে খুলনা বিভাগের পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে। কয়েক দিনের মাথায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণাও দেয়া হয়। পরে দেখা যায়, প্রত্যাহার নয়, গোটা দেশে পরিবহন ধর্মঘটের বিস্তৃতি ঘটেছে। পরিবহন শ্রমিকদের ফেডারেশনের নেতৃত্বে আছেন সরকারের একজন মন্ত্রী। শোনা যায়, পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তক্রমেই দেশব্যাপী পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়। এ-ও লক্ষ্য করার বিষয়, পরিবহন শ্রমিকরা কেবল নিজেরাই পরিবহন বন্ধ করে দেয় না, তারা তাদের আওতাবহির্ভূত পরিবহন বিশেষত ব্যক্তিগত পরিবহন চালাতেও বাধা প্রদান করেছে। বিক্ষোভ সমাবেশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতেও তাদের দেখা গেছে। রাজধানীর গাবতলীতে দু’দিন ধরে এই সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের রেকারে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। শ্রমিকদের আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। ধর্মঘট বা চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে আদালতের রায় বদলানোর কৌশল কোনো উত্তম কৌশল বলে বিবেচিত হতে পারে না। পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সংশ্লিষ্ট নেতা ও মন্ত্রী বহির্বিশ্বের নজির উল্লেখ করে যে মন্তব্য করেন তা পরিণামদর্শী মন্তব্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এ রকম ধর্মঘট ডেকে প্রতিবাদ করার ঘটনা আদালতের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের শামিল। রায় যেটা হয়েছে তা মনঃপূত না হলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিলের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। তা না করে সংঘশক্তির দর্প প্রদর্শন সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
এটা ঠিক, আমাদের দেশের সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি অতিসাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কোনো কিছুতেই দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল রোখা যাচ্ছে না। গত ১৯ দিনে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১৯২ জন। সড়ক যে মৃত্যুর সড়কে পরিণত হয়েছে এ থেকে তা স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। জানা যায়, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। আহত হয় এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণ থাকলেও প্রধান কারণ বেপরোয়া গাড়ি চালানো। এ জন্য চালকই দায়ী। অন্যদিকে সড়কের ত্রুটি, গাড়ির ফিটনেস না থাকা, ট্রাফিক আইন বাস্তবায়নে পুলিশের অবহেলা, সড়ক-মহাসড়কে নসিমন-করিমনসহ কম গতির যানবাহন চলাচল, পথচারীদের অসচেতনতা ইত্যাদিও কম দায়ী নয়। তাই দুর্ঘটনার জন্য অদক্ষ, অপ্রশিক্ষিত ও অপরিণামদর্শী চালক যেমন দায়ী তেমনি সব দুর্ঘটনার জন্যই চালক দায়ী নয়। বিষয়টি তাই সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি রোধ করতে হলে চালক, মালিক, পুলিশ সবাইকে সতর্ক সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সবাই মিলে একযোগে কাজ করতে হবে। গুরুদ-ের ব্যবস্থা হলেই দুর্ঘটনা বন্ধ হবে, কিংবা পরিবহন ধর্মঘট করলেই সমাধান হয়ে যাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটা অবশ্যই স্বস্তির ব্যাপার। আমরা আশা করবো, ভবিষ্যতে যেন অযৌক্তিক-অকারণে পরিবহন ধর্মঘট আর না হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন