গত বুধবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং একটি নতুন ট্রান্সমিশন ও বিতরণ লাইন উদ্বোধন করতে গিয়ে দেশের বিদ্যুৎ সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছেন তা বিদ্যুৎ বঞ্চিত কোটি কোটি মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঘরে ঘরে আলো জ্বালব, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের একটি ঘরও আর অন্ধকারে থাকবে না। বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে আমরা গড়ে তুলব। তিনি উল্লেখ করেন, উদ্বোধন করা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে মোট এক হাজার ৩৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। এতে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হবে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে সদ্য নির্মিত আটটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, একটি সাবস্টেশন ও একটি সঞ্চালন লাইনও রয়েছে। প্রকল্পগুলো চালু হলে বিভিন্ন জেলার ১০টি উপজেলা এবং বান্দরবানের একটি উপজেলায় বিদ্যুৎ শতভাগ সরবরাহ নিশ্চিত হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, উৎপাদন বৃদ্ধি করে বর্তমানে আমরা ১৫ হাজার ৩৫১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব করেছি। শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সমগ্র এলাকায় বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা করা হবে। যেসব জায়গায় গ্রিড লাইন যাওয়া কষ্টকর, সেখানে সোলার প্যানেল বসানো হবে। এখানে ৪৬ হাজার সোলার হোম করা হবে।
আমরা আগেই বলেছি যে, প্রধানমন্ত্রীর এমন বিপুল আশ্বাস পেয়ে জনগণ বিপুলভাবে আশান্বিত হয়েছে। তবে একই দিন ঢাকার একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত অপর একটি খবর কিছুটা হলেও আমাদের হতাশ করেছে। ঐ খবরে বলা হয়েছে যে, বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বাংলাদেশ এখন এশিয়ায় শীর্ষ স্থানে অবস্থান করছে। বলা হয়েছে, বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় প্রতি মাসে গড়ে ৬৫ বার বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ক্ষেত্রে শীর্ষ তিনে থাকা অপর দুটি দেশ হলো যথাক্রমে নেপাল ও পাকিস্তান। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকাশিত ‘মিটিং এশিয়া’স ইনফ্রাস্ট্রাকচার নিডস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি কেমন সেটা জানার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা কতটা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ পায় সেটা জানা। এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে এক মাসে গড়ে ৬৫ বার বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। নেপালে এক মাসে এমন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে ৫১ বার, পাকিস্তানে ৩১ বার। এছাড়া আফগানিস্তান ও ভারতে মাসে গড়ে ১০ বারের বেশি বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। প্রতিবেদন অনুসারে, এশিয়ার আর কোনো দেশে মাসে গড়ে ১০ বারের বেশি বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে না। বিদ্যমান এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে আমাদের আশাবাদ হোঁচট খায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। একথা সত্যি। কিন্তু পাশাপাশি এটিও সত্য যে, তার সরকার বিগত আট বছর ক্ষমতায় আছে। এই আট বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন বেড়েছে তেমনি বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়েছে। এটি একটি চক্রের মতো কাজ করে। একদিকে উৎপাদন বাড়ে, অন্যদিকে চাহিদা বাড়ে। আবার উৎপাদন বাড়ে, ফের চাহিদাও বাড়ে। এই কারণে কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না যে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা কত এবং উৎপাদন কত। সে জন্যই বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, সরকারের উচিত একটি সময়সীমা বেঁধে দেয়া। সেই সময়সীমার মধ্যে চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন এমন হারে বাড়বে যে ঐ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে যে উৎপাদন হবে সেটি যেন চাহিদা মিটাতে পারে এবং প্রয়োজনে চাহিদার চেয়েও উৎপাদন যেন কিছুটা উদ্বৃত্ত থাকে।
একটি সময় ছিলো যখন বলা হতো যে, চাহিদা আট হাজার মেগাওয়াট। প্রকৃত উৎপাদন ৭ হাজার থেকে ৭ হাজার ৪ শত মেগাওয়াট। এখন প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী উৎপাদন দেড় হাজার মেগাওয়াট। তারপরেও কিন্তু চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। কারণ ঐ একটি। জনসংখ্যা বাড়ছে, ঘরবাড়ি বাড়ছে, কলকারখানা বাড়ছে এবং অন্যান্য স্থাপনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিদ্যুতের চাহিদা তার চেয়ে অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সরকারের আমলে যে পদ্ধতিতে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে সেই পদ্ধতি অনেকের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি। পানি, গ্যাস বা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ভাড়াভিত্তিক ছোট ছোট রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এই ধরনের কেন্দ্রের সংখ্যা এখন ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। দুই বা তিন বছরের মেয়াদে এসব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। অধিকাংশ কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০১৪ সালে। তারপর সেই মেয়াদ ক্রমাগত বাড়ানো হয়েছে। কুইক রেন্টালের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রক্রিয়া অনন্ত অসীম বলে মনে হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মত এই যে, রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বা পিকিং প্ল্যান্ট অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। বছরের পর বছর ধরে সরকার এসব প্ল্যান্টকে ভর্তুকি দেবে কেন? আর চূড়ান্ত পরিণামে তো ভর্তুকির এই টাকা জনগণের পকেট থেকে কেটে নেয়া হচ্ছে। সে জন্য বিশেষজ্ঞরা এক বাক্যে বলছেন যে, অবিলম্বে এসব ভাড়াভিত্তিক ছোট ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করা হোক। পানি, গ্যাস বা কয়লাভিত্তিক বৃহদায়তন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের চেষ্টা করা হোক। আরও একটি কথা, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করাও জরুরি। ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট বিদ্যুৎ পরিষেবার দুর্বলতাই প্রমাণ করে। বিদ্যুৎ সরবরাহও নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন