শিশুদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আনন্দদায়ক,প্রয়োগিক ও সহজ করে তুলতে শত বছর ধরে প্রয়াস চালাচ্ছেন পশ্চিমা শিক্ষাগবেষক ও শিক্ষাবিজ্ঞানীরা। আসলে আনন্দহীন শিক্ষা কোন শিক্ষাই নয়। আমরা যখন শিক্ষা ব্যবস্থার পুরনো পরিকাঠামো পরিবর্তন করে নতুন শিক্ষানীতির আওতায় শিক্ষাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছি, তখন শিশুমনস্তত্ত¡ ও শিক্ষাবিজ্ঞানের ফলিত ধারাকে উপেক্ষা করে এক অদ্ভুত বিপ্রতীপ অবস্থান প্রত্যক্ষ করছি। শিশুর উপর ক্রমবর্ধমান হারে পাঠ্য বইয়ের বোঝা চাপিয়ে শ্রেণী ও পাবলিক পরীক্ষায় উচ্চগ্রেড নিশ্চিত করার প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিয়ে বছরের পুরোটা সময় নিরানন্দ শিক্ষাক্রমে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের সমস্যাগুলো কি কি, কিভাবে এসব প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে শিশুদের আগামী দিনের যোগ্য-দক্ষ জনশক্তি ও সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপযোগী করে গড়ে তুলতে সক্ষম করে তোলা যায়, তার বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত ছাড়াই আমরা শুধু বইয়ের বোঝা বাড়িয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্ভট তৎপরতা দেখছি। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দ্রæততম সময়ে জাতির সামনে একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগকে সরকার তার অন্যতম সাফল্যজনক পদক্ষেপ হিসেবে দাবি করে। তবে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও নতুন সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন একটি দীর্ঘমেয়াদি চলমান প্রক্রিয়া। দু’এক বছরেই তার সাফল্য বা গলদ সম্পর্কে শেষ কথা বলা যায়না। নতুন শিক্ষানীতি গৃহীত হওয়ার পর ইতিমধ্যে ৭ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন শিক্ষাব্যবস্থার গলদ এবং উন্নয়নের নামে শুভঙ্করের ফাঁক এবং বৈষম্য অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
সংবিধানে সকল শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সম্পদের স্বল্পতার কারণে একদিকে সরকার দেশের সব শিশুর মানসম্মত প্রাথিমক-মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছেনা, অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান নানাবিধ বৈষম্য এবং পাঠ্যক্রমকেও আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় যুগোপযোগী করে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতার সুযোগে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একেকটি বাণিজ্যিক মুনাফাবাজির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার ব্যয় ও বৈষম্য বৃদ্ধির পাশাপাশি অপরিকল্পিত অবিন্যস্ত শিক্ষাক্রমের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে লক্ষ লক্ষ শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীর উপর। নতুন শিক্ষানীতি গৃহীত হওয়ার আগ পর্যন্ত যেখানে অষ্টম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীকে অনূর্ধ্ব ৮টি বিষয় পড়তে হতো, এখন তাদেরকে ১৩টি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয় এবং বইয়ের বোঝা বহন করতে হয়। বিশ্বের কোথাও শিশুদের উপর এমন অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা চাপানোর নজির নেই। এমনকি আমাদের দেশের ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা যেখানে এসএসসি সমমানের ওলেভেল কারিকুলাম অনুসারে স্বাধীনভাবে ৫টি থেকে ৮টি সাবজেক্টে পরীক্ষা দিয়ে বিশ্বমানের ফলাফল অর্জন করছে, সেখানে সাধারণ শিক্ষাবোর্ড সমূহের শিক্ষার্থীদেরকে ১৪-১৫টি বিষয়ে বাধ্যতামূলকভাবেই পরীক্ষা ও শ্রেণী কার্যক্রমে অংশ নিতে হচ্ছে। আমাদের শিশুরা খেলাধুলাসহ নানাবিধ সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে বাস্তব জ্ঞান অর্জনের কোন সুযোগই পাচ্ছে না। এভাবে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ সম্ভব নয়।
নতুন শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা হলেও এখনো পঞ্চম শ্রেণী ও ষষ্ঠশ্রেণীর পাঠ্যক্রমের মধ্যে অস্বাভাবিক ব্যবধান বিদ্যমান। পঞ্চম শ্রেণীতে বাধ্যতামূলক ৫টি বিষয়ের বিপরীতে ষষ্ঠশ্রেণীতে ১৩টি বিষয়ে পড়তে হচ্ছে শিশুদের। ১৩ টি বিষয়ের বই, স্কুল ডায়রী, হোমওয়ার্ক খাতাসহ আনুষঙ্গিক শিক্ষা সরঞ্জাম বহন করতে গিয়ে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে এ বিষয়ে একটি রুলও জারি করা হয়েছে। রুলে বলা হয়েছে, পাঠ্যবই সমেত স্কুলব্যাগের ওজন শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশী হতে পারবে না। এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নেরও নির্দেশনা দিয়েছে উচ্চ আদালত। শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তার পরিশ্রম তখনই সার্থক হবে যখন শিক্ষাব্যবস্থার এসব গলদ ও বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম শিশুদের জন্য আরো সহজ, সৃজনশীল ও প্রতিভা বিকাশের উপযোগী হয়ে উঠবে। শিক্ষামন্ত্রী উচ্চশিক্ষা খাতের গবেষণা কার্যক্রমে গতি সঞ্চারের মধ্য দিয়ে শিক্ষাখাতে বাংলাদেশকে রফতানীকারক অবস্থান গড়ে তোলার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। তার এই প্রত্যাশা নিঃসন্দেহে অগ্রসর চিন্তার পরিচায়ক। এ জন্য প্রাথমিক শিক্ষাক্রম, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দূর করতে হবে। শিশুদের উপর অতিরিক্ত পাঠ্যবইয়ের বোঝা কমিয়ে পাঠ্যবইকে সহজবোধ্য ও সৃজনশীল চিন্তার সহায়ক করে প্রণয়ন করতে হবে। কোচিং বাণিজ্য, গাইডবই, নোটবই এবং শিক্ষাখাতে সব ধরনের অনৈতিক প্রতিযোগিতা বন্ধের দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন