সরকারের ভাষায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, মানুষ বেশ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছে। তবে সরকারেরই বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে এর বিপরীত চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বেসরকারি সংস্থা কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর বিভিন্ন তথ্য ও প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, জীবনযাত্রায় চাপ বেড়েছে। মানুষের আয় না বাড়লেও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম থেকে শুরু করে অন্যান্য খাতে ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হচ্ছে। মৌলিক চাহিদা মেটাতে তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। এর মধ্যে আয়ের বৈষম্য অন্যতম কারণ হয়ে রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছাড়া বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি না পাওয়া বা কোনো নীতিমালা না থাকায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে বছর বছর বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত এক দশকে বেকারত্বের হার বেড়েছে ১.৬ শতাংশ। নতুন কর্মসংস্থানের হার কমেছে ২ শতাংশ। প্রতি বছর ২৭ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও কাজ পাচ্ছে মাত্র ১ লাখ ৮৯ হাজার। এর ফলে প্রতিবছরই বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার থেকে যাচ্ছে। এসব পরিসংখ্যানই সাক্ষ্য দিচ্ছে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভাল নেই। তাদের অত্যন্ত টেনশনের মধ্যে জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
আমরা লক্ষ্য করেছি, সরকারের মধ্যে একটা ব্যবসায়িক মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সরকার উন্নয়ন কাজ, ব্যয় মেটানো এবং সরকার পরিচালনার খরচ চালানোর জন্য সাধারণ মানুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। দফায় দফায় পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের দামসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবার দাম বৃদ্ধিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ করে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা বের করে নিচ্ছে। প্রতি বছরই নিয়ম করে এসব খাতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হারে বাড়াচ্ছে। এর প্রভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে ৫ শতাংশের উপরে। সাথে বাড়ছে বছরের শুরুতে ৮ থেকে ১০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া। জনসাধারণের জীবনযাপন সঙ্কুচিত করার এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই আসছে নতুন ভ্যাট আইন। এতে সব পণ্যের ওপর দিতে হবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট। এই ভ্যাটের বোঝা বহন করতে হবে সাধারণ মানুষকে। এছাড়া আগামী বাজেটের আকার ৪ লাখের উপরে হবে। বাজেটের বাড়তি অর্থ যোগাতে সরকারকে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের উপরই চেপে বসতে হবে। অথচ সরকার মানুষের আয় বাড়ানোর কোনো পথ তৈরি করতে পারছে না। উল্টো ব্যয় বাড়ানোর যত প্রক্রিয়া আছে, তার সব পথই অবলম্বন করছে। জনসাধারণের কাছ থেকে অনুচিতভাবে সরকারের এই অর্থ আহরণের প্রবণতা উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। সরকারের কাজ হচ্ছে, জনসাধারণের জীবনযাপনকে সহজ করার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। তাদের সমস্যার দিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখা। এক্ষেত্রে যদি সরকারকে কষ্টও করতে হয়, তবে সে কষ্ট স্বীকার করা তার দায়িত্ব। আমরা সরকারের মধ্যে জনসাধারণের জন্য কষ্ট স্বীকারের এ প্রবণতা দেখছি না। সরকার জনগণকে ভর্তুকি না দিয়ে নিজের ভর্তুকি পূরণ করার জন্য জনসাধারণের কাছ থেকে যত রকমে পারা যায় আদায় করে নিচ্ছে। আমরা জানি, পানি ও জ্বালানি খাতে সরকার বেশ লাভজনক অবস্থায় রয়েছে। এ লাভ করছে, দাম বৃদ্ধি করে জনসাধারণের পকেট থেকে অর্থ আদায় করে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ লাভ করা কার জন্য? সরকারের জন্য নাকি জনসাধারণের জন্য? সরকারের আচরণে প্রতীয়মাণ হচ্ছে, জনসাধারণের জন্য নয়, নিজের জন্য। তা নাহলে ভর্তুকি দিয়ে হলেও জনসাধারণের সুবিধা নিশ্চিতের ব্যবস্থা নিত। জনদরদী সরকারের কাজ এটাই। সরকারকে যদি লাভ করতেই হয়, তবে লাভ করার পরিবেশ তার সৃষ্টি করাই স্বাভাবিক। আমরা দেখছি, সরকারের নিজস্ব নীতি হোক বা ব্যর্থতা হোক, লাভ করার জন্য সরকারি-বেসরকরি যে বিনিয়োগ প্রয়োজন, তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সরকার পারেনি। দেশে বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। বিনিয়োগের এ খরা বহুদিন ধরেই চলছে। এ থেকে উত্তরণে সরকারের সাফল্য নেই বললেই চলে। ফলে প্রতি বছর দেশে লাখ লাখ বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে টান ধরছে। সরকার টানাপড়েনের মধ্যে পড়ছে। তার এ টানাপড়েন মেটাতে জনগণের অর্থের উপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। তার এ নির্ভরশীলতা জনগণের উপর বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বলা বাহুল্য, সরকারের বোঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কোনো কালে সম্ভব হয় না, এখনও হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি থেকে জনগণ কবে মুক্তি পাবে এবং সরকার কবে তার এ মনোভাব থেকে বের হয়ে আসবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
জনসাধারণকে চাপে ফেলা সুশাসনের পরিচায়ক হতে পারে না। জনবান্ধব সরকারের কাজ হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে জনসাধারণের জীবনযাপনকে সহজ করা। আমরা তার ব্যতিক্রম লক্ষ্য করছি। দেশের সার্বিক অর্থনীতির হাল কি, তা সরকারেরই বিভিন্ন সংস্থার তথ্য-উপাত্ত থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জনগণের অর্থে সরকার চলে। তবে সরকার চালানোর অর্থ এই নয়, জনগণের কাছ থেকে বিভিন্ন উপায়ে অর্থ আদায় করে, তাদের দুর্ভোগে ফেলে সরকার চালাতে হবে। জনগণের সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা না করে তাদের চেপে ধরে বছরের পর বছর বিভিন্ন সেবা খাতে দাম বৃদ্ধি করে অর্থ আদায় করতে হবে। আমরা দেখেছি, পার্শ্ববর্তী দেশে সেবাখাতসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করতে সরকার বহুবার চিন্তা করে। দাম বৃদ্ধির ফলে জনগণের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তাদের কী সমস্যা হবে- এসব নিয়ে প্রতিনিয়তভাবে। আমাদের দেশে উল্টো। দাম বৃদ্ধি করলে জনগণের কী সমস্যা হবে, তা নিয়ে সরকার কোনো চিন্তা করে না। সরকারের মনোভাব এরকম থাকে, দাম বাড়িয়ে দেয়ার কাজ দিলাম, জনসাধারণ কোত্থেকে দেবে তা তাদের ব্যাপার। আমরা মনে করি, জনসাধারণের সুবিধা-অসুবিধার কথা অধিক ভেবে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। কেন কর্মসংস্থানের হার কমে গেছে, বিনিয়োগ কেন হচ্ছে না, সেবা খাতের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি করলে সাধারণ মানুষের কী সমস্যা দেখা দেবে- এসব বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন