পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ স্বীকার করেছেন, গঙ্গাচুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। তার মতে, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে বাংলাদেশ প্রতিবছর ৫২ হাজার কিউসেক পানি পেত। এখন পায় ২০ থেকে ২৫ হাজার কিউসেক। তিনি জানিয়েছেন, এখন পানির লেভেল নিচে নেমে গেছে, সে কারণে সঠিক পরিমাণ পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত কারিগরি টিম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। মন্ত্রী অবশ্য জানাননি, কি কারণে পানির লেভেল কমে গেছে, যার জন্য বাংলাদেশ তার ন্যায়সঙ্গত পানি পাচ্ছে না। তিনি না জানালেও দেশের মানুষ জানে, কি কারণে গঙ্গা-পদ্মায় পানির লেভেল আগের জায়গায় নেই। ফারাক্কা বাঁধে পানি আটকে উজান থেকে যথেচ্ছ পানি প্রত্যাহারের কারণেই বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। গঙ্গা চুক্তির পর বাংলাদেশ কখনই চুক্তিতে বর্ণিত পানি পায়নি, এবারও এখন পর্যন্ত পায়নি। ভারতের অতি পুরাতন যুক্তি হলো, ফারাক্কা পয়েন্টে পানি সেভাবে আসছে না, যতটুকু আসছে তাই দু’দেশের মধ্যে ভাগাভাগি হচ্ছে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি না আসার কারণ ভারত কখনোই বলে না। আমাদের কর্তাব্যক্তিরাও ভারতের সুরেই কথা বলেন, তারাও আসল কারণ উল্লেখ করেন না। চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা দেখা দিলে কিংবা কোনো ব্যাপারে কোনো দেশের বক্তব্য থাকলে তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকলেও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক দীর্ঘদিন হচ্ছে না। বাংলাদেশ বার বার তাকিদ দিলেও ভারত বৈঠকে বসতে রাজি হচ্ছে না। মন্ত্রীর কথা অনুযায়ী দুদেশের কারিগরি টিম কি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। তা কারো জানা নেই। আলোচনা যদি না হয় তবে ওই পরীক্ষা-নিরীক্ষারও কোনো মানে থাকে না।
ফারাক্কা পয়েন্টে পানি কম আসা বা না আসার বিষয়টি আরো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। উজান থেকে পানি টেনে নেয়া হলে পানি কম আসবেই। যা আসে তাও যদি ভারত নিয়ে নেয়, তবে বাংলাদেশের পানি পাওয়ার কথা নয়। আসলে ফারাক্কা চুইয়ে বা তার ফাঁক-ফোকর গলিয়ে যতটুকু পানি আসে, বাংলাদেশ কেবল সে টুকুই পায়। এতে বাংলাদেশের চাহিদা বা প্রয়োজন কিছুমাত্র পূরণ হতে পারে না। জানুয়ারিতেই পদ্মার পানিতে টান ধরেছে। প্রতিদিন পানি হ্রাস পাচ্ছে। ইতোমধ্যে পদ্মার বুকে বড় বড় চর জেগে উঠেছে। কোথাও কোথাও পদ্মা মরা খালে পরিণত হয়েছে। মানুষ ও গাড়ি-ঘোড়া পার হচ্ছে অবলীলায়। কোথাও কোথাও চলছে চাষাবাদ। পদ্মার পানির ওপর নির্ভরশীল উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব নদীই এখন পানিশূন্য। নদীর পানি-নির্ভর সেচ ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। পদ্মায় পানির অভাবে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প এবং তিস্তায় পানির অভাবে তিস্তা সেচ প্রকল্পে অচলাবস্থা নেমে এসেছে। সেচের পানি ছাড়া আজকাল কৃষি অচল। কৃষকরা পানি না পেয়ে দিশাহারা। পানির অভাবে উৎপাদন মারাত্মকভাবে মার খাবে, কৃষকরা পথে বসবে, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে- এ আশঙ্কা প্রবল। এ কথা কারো অজানা নেই, নদীতে পানি না থাকার কারণে সেচ ব্যবস্থা অনেকাংশের ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। প্রতি বছর ভূগর্ভ থেকে মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তরও আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। এক খবরে জানা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে গত দু’বছরে পানির স্তর ১২ ফুট নিচে নেমে গেছে। অন্যান্য অঞ্চলের অবস্থাও এর চেয়ে ব্যতিক্রম নয়। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার নানামুখী ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া কথা জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করলেও উৎপাদনের স্বার্থে পানি উত্তোলন কমানো যাচ্ছে না। বরং বাড়ছে।
ভারত অভিন্ন নদীর পানি আটকে দিয়েছে। একতরফাভাবে পানি সরিয়ে বাংলাদেশকে মারাত্মক অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় যেমন জরুরি তেমনি নদী ন্যাব্য রাখার বিকল্প পদক্ষেপ নেয়াও অত্যাবশ্যক। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ধরে দেশের মানুষ গঙ্গা ব্যারাজের কথা শুনে আসছে। সেই ব্যারাজ আজও নির্মিত হয়নি। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলেও তা থেমে আছে ভারতের আপত্তি ও বিরোধিতার কারণে। গঙ্গা ব্যারাজ হলে অনেকগুলো নদী যেমন নাব্যতা ফিরে পাবে, তেমনি পানির একটা বিরাট সংরক্ষণাগার তৈরি হবে। এতে উৎপাদন বাড়বে এবং অন্যান্য সুবিধাও পাওয়া যাবে। এ ব্যারাজ নিয়ে ভারতের আপত্তির বিষয়টি বিশেষজ্ঞরা আমলযোগ্য মনে করেন না। তারপরও সরকার এনিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ কেন নিচ্ছে না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। শোনা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের সময় এ বিষয়ে একটা সমঝোতা হতে পারে। আমাদের কথা হলো, জাতীয় প্রয়োজনেই গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ জরুরি। সেই সঙ্গে নদী খনন, সংস্কার, ড্রেজিং ইত্যাদি জোরদার করতে হবে। পানি ছাড়া নদী বাঁচবে না। নদী না বাঁচলে দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। মানুষ মহাবিপর্যয়ের শিকার হবে। সুতরাং আগের কাজ আগে করতে হবে এবং যত দ্রæত সম্ভব করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন