শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষার প্রেক্ষাপট ও যুগ চাহিদায় করণীয়

প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মিযানুর রহমান জামীল
॥ দুই ॥
দারুল উলুম দেওবন্দ সেই কার্যক্রমের নতুন অধ্যায়। যা আজ বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত নাম। নতুন করে এর কোন পরিচয় পেশ করার প্রয়োজন নেই। তবুও প্রসঙ্গক্রমে সংক্ষিপ্ত কিছু ইতিহাস তুলে ধরছি। দারুল উলূম দেওবন্দ উপমহাদেশে ইসলামী চেতনার পীঠস্থান, বিশ্বব্যাপী ইসলামী রেনেসাঁ ও পুনর্জাগণের সবচেয়ে বড় দুর্গ এবং ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সবচেয়ে বড় ঝরণাধারা। দারুল উলূম দেওবন্দের মহান দীনি, ইলমী ও ইসলাহী কার্যক্রম শুধু উপমহাদেশেই নয়, বরং গোটা বিশ্বে এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যে, তা কেবল কোন হতভাগা ও দুর্ভাগা ব্যক্তিই অস্বীকার করতে পারে, নতুবা যে কোন সচেতন মানুষ দারুল উলূম দেওবন্দের গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক দীনি কর্মকা-কে স্বীকৃতি দিতে ও তার প্রশংসা করতে বাধ্য। আজ উপমহাদেশে তথা বিশ্বব্যাপী যেসব সক্রিয় জামাআত, সংগঠন, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান মহান দীনের প্রচার-প্রসারে নিবেদিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের প্রত্যেকেরই পেছনে কোন না কোনভাবে দারুল উলুম দেওবন্দের চেতনা ক্রিয়াশীল রয়েছে।
দারুল উলূমের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল এই যে, এখানকার শিক্ষাজীবন শেষ করে বের হওয়া তালিবে ইলম বাইরের দুনিয়ায় যেন অপরিচিত ও অপাংক্তেয় না হয়। তাকে যেন সময় ও সমাজের সাথে ‘খাপ না খাওয়া’ ভিন্ন যুগের, ভিন্ন জগতের মানুষ ভাবা না হয়। এমন যেন না হয় যে, দারুল উলূমের ইলমী পরিবেশে কয়েক বছর জীবন ও জগত থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সময় ও সমাজ থেকে বেখবর থেকে হঠাৎ কর্মের ময়দানে হাজির হলো, আর দিশেহারা অবস্থায় পড়ে গেল, বরং এমন যেন হয় যে, এখানে থাকা অবস্থায়ও নিয়মিতভাবে (এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে) বাইরের আলো-বাতাস সে গ্রহণ করতে পারে এবং উন্মুক্ত বাতায়ন পথে ভিতর থেকে বাইরের জগত অবলোকন ও পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
দারুল উলূমের যখন প্রতিষ্ঠা, তখন আমাদের দ্বীনী মাদারেসে পঠন-পাঠনের একটি বিশেষ ভাষা ও পরিভাষা প্রচলিত ছিল এবং চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের জন্যও ছিল আলাদা রীতি ও শৈলী। এটা ছিল আমাদের প্রাচীন শিক্ষা-ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফল। তার ভাষা ও বাক-ধারা এবং চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের রীতি ও পদ্ধতি, সবকিছু সে যুগের প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তখন মাদরাসায় পত্র-পত্রিকার তেমন প্রচলন ছিল না বরং দোষণীয় বিষয় ছিল। সেই সময়ে সেই পরিবেশে দারুল উলূমের ছাত্রদের এমন একটি সংগঠনের ভিত্তি স্থাপন করা, যার আলাদা পাঠাগার থাকবে, পত্র-পত্রিকার বিভাগ থাকবে, সাপ্তাহিক বক্তৃতা ও রচনা প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান থাকবে এবং এর যাবতীয় আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা, এমনকি সংগঠনের পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব ছাত্রদের হাতে থাকবে- এটা ছিল অত্যন্ত বাস্তববাদী চিন্তা এবং সময়ের সাহসী পদক্ষেপ।
এখন তো এই ‘সাংস্কৃতিক চিন্তা’ আমাদের মাদরাসা জীবনে এমনভাবে মিশে গেছে যে তাতে ‘অভিনবত্ব’ কিছুই নেই। কিন্তু আজ থেকে সত্তর বছর আগে আঠারো শতকের একেবারে শেষ দিকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত দারুল উলূমের বিচক্ষণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ‘জমইয়াতুল ইছলাহ’ প্রতিষ্ঠার এই সাহসী পদক্ষেপ আহলে মাদারেসের জন্য ছিল চমকে উঠার মত ঘটনা। সে যুগ যারা দেখেছেন এবং ইলমী মহলের মন-মানস ও চিন্তা-চেতনার সাথে যাদের পরিচয় ছিল তারাই শুধু এর গুরুত্ব ও গভীরতা অনুধাবন করতে পারবেন।
সে যুগের সে পরিবেশের বিচারে এটা ছিলো অত্যন্ত কল্যাণপ্রসূত একটি পদক্ষেপ এবং কোন সন্দেহ নেই যে, আল-ইছলাহ যুগ ও সময়ের জন্য তখন দিশারীর ভূমিকা পালন করেছে, এখনো করে চলেছে। এখানে যারা শিক্ষা লাভ করেছেন, অনুশীলন করেছেন এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। সমাজের কর্মক্ষেত্রে নেমে তারা তা বেশ কাজে লাগিয়েছেন। এখানে তাদের যোগ্যতা ও প্রতিভার এমন পরিচর্যা হয়েছে যে, পরবর্তীতে সময় ও সমাজের সামনে দাঁড়াতে তাদের কোন রকম দ্বিধা-সংকোচের সম্মুখীন হতে হয়নি। সুতরাং আল-ইছলাহ যারা প্রতিষ্ঠা করেছিল, দারুল উলূমের সেই সুসন্তানদের কীর্তি ও অবদানের যত উচ্চ প্রশংসাই করা হোক এবং তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে যত কৃতজ্ঞতাই নিবেদন করা হোক, তা সামান্য।
যে কোন কাজের এবং যে কোন পদক্ষেপের মূল্যায়ন হয় সমকালের চাহিদা ও প্রয়োজনের মানদ-ে। আল-ইছলাহ -এর প্রতিষ্ঠা যে সময়ের ঘটনা তখনকার জন্য সেটা ছিলো আলিম সমাজের প্রাগ্রসর চিন্তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং নিঃসন্দেহে দারুল উলূম ছিল এই চিন্তার দিশারী ও পথিকৃত। কিন্তু সামনে এগিয়ে চলাই হলো সময়ের ধর্ম। সময় সদা গতিশীল, মুহূর্তের জন্য তার যাত্রা বিরতি নেই। তাই সময়ের ব্যবধানে চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন হয় এবং চাহিদা ও প্রয়োজনের রূপবদল হয়। সামনে আসে নতুন নতুন সমস্যা ও জিজ্ঞাসা। তৈরি হয় কর্ম ও পরীক্ষার নতুন নতুন ক্ষেত্র এবং উলামায়ে উম্মতকে দাঁড়াতে হয় অন্য রকম কিছু চ্যালেঞ্জের সামনে, যার সফল মোকাবেলার উপর নির্ভর করে ইলম ও আহলে ইলমের অস্তিত্ব।
এখন তো সাধারণ মাদরাসায় লেখালেখির চর্চা এবং বক্তৃতা-বিতর্কের অনুশীলন হয়, দেয়ালিকা, এমনকি নিয়মিত পত্র-পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। কিন্তু বন্ধুরা! সময় এখন অনেক এগিয়ে গেছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে। এখন শুধু পত্র-পত্রিকার পাতায় বিচরণ, বক্তৃতা-বিতর্কে অংশগ্রহণ এবং মুখে বা কলমে চিন্তার সুবিন্যস্ত ও পরিমার্জিত উপস্থাপন যোগ্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। এগুলো এখন বৈশিষ্ট্যের বিষয় নয়, বরং বিগত যুগের স্মৃতিচিহ্নমাত্র। যা শুধু এজন্য বহাল রাখা হয়েছে যে, হয়ত তা চিন্তার প্রসার এবং যুগের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। নচেৎ বাস্তবতা এই যে, পরিবর্তিত সময়ের বিচারে এসবে কোন চমক বা ঝলক নেই, কীর্তি বা কৃতিত্ব নেই। সময় এখন আরো কিছু চায়, সমাজ এখন অন্য কিছু চায়।
বর্তমান মুসলিম সমাজের চিন্তা-জগতে এক ব্যাপক নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য ছড়িয়ে পড়েছে। এই উম্মাহ এবং এই দ্বীনের মাঝে যে চিরন্তন যোগ্যতা গচ্ছিত রাখা হয়েছে সেই যোগ্যতা ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে যুব সমাজ এবং আধুনিক শিক্ষিত মহলে ভয়ানক অনাস্থা-অনিশ্চয়তা দানা বেঁধে উঠছে, সর্বোপরি দ্বীনের ধারক-বাহক আলিমদের নতুন প্রজন্মে মারাত্মক হতাশা ও হীনমন্যতা শিকড় গেড়ে বসেছে। এগুলো দূর করে যুগ ও সমাজের লাগাম টেনে ধরার জন্য এবং দ্বীন ও শরীয়তকে নয়া জামানার নয়া তুফান থেকে রক্ষা করার জন্য এখন অনেক বেশি প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন। অনেক বড় ইলমী জিহাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয় অর্জনের প্রয়োজন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন