মিযানুর রহমান জামীল
॥ শেষ কিস্তি ॥
এখন প্রয়োজন আরো বেশী আত্মনিবেদনের, আত্মবিসর্জনের এবং আরো ঊর্ধ্বাকাশে উড্ডয়নের।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের পূর্বসূরিগণ অনেক কালজয়ী কীর্তি ও অবদান রেখে গেছেন। বিশেষত নাদওয়াতুল উলামার প্রথম কাতারের লেখক-গবেষক ও চিন্তাবিদগণ তাদের সময় ও সমাজকে অনেক কিছু দিয়েছেন এবং নতুন প্রজন্মকে ইসলাম ও ইসলামী উম্মাহর ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে যথেষ্ট আশ্বস্ত করতে পেরেছেন। যে সব সমস্যা ও জিজ্ঞাসা তখন ‘জ্বলন্ত’ ছিল সেগুলোর উপর চিন্তা-গবেষণার যে ফসল এবং যে বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান তারা রেখে গেছেন তা সে যুগের জন্য খুবই কার্যকর ও যুগান্তকর ছিল, কিন্তু সেগুলোর চর্বিত চর্বণ এখন বিশেষ কোন কৃতিত্ব বলে গণ্য হবে না এবং তাতে যুগ ও সমাজের হতাশা দূর হবে না।
জ্ঞান ও গবেষণার ক্ষেত্র এখন অনেক ব্যাপক ও বি¯তৃত হয়ে পড়েছে। ইলমের যে প্রাচীন ভা-ার ও গুপ্ত সম্পদ পূর্ববর্তী আলিমদের কল্পনায়ও ছিল না, আধুনিক প্রকাশনা বিপ্লবের কল্যাণে এবং প্রকাশনা সংস্থাগুলোর নিরলস প্রচেষ্টায় তা এখন দিনের আলোতে চলে এসেছে। আগে যে সব কিতাবের শুধু নাম শুনেছি এখন তা গ্রন্থাগারের তাকে তাকে শোভা পায়। তাছাড়া চিন্তার পথ ও পন্থা এবং অস্থির চিত্তকে আশ্বস্ত করার উপায়-উপকরণে এত পরিবর্তন ঘটেছে যে, পুরোনো ধারার অনুকরণ এখন কিছুতেই সম্ভব নয়। সে যুগের বহু আলোচনা এখন তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। একটা সময় ছিলো যখন আল্লামা শিবলীর ‘আল-জিযয়া ফিল ইসলাম’ কে মনে করা হতো মহাআলোড়ন সৃষ্টিকারী কিতাব।
‘এক নজরে আওরঙ্গজেব’ তো ছিল ইসলামের রীতিমত বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয়। একইভাবে ‘আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার’ ছিল ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে দাঁতভাঙ্গা জবাব। কিন্তু এখন তা এতই গুরুত্বহীন যে, এ সম্পর্কে বলার বা লেখার নতুন কিছু নেই এবং যুগ ও সমাজের তাতে তেমন আগ্রহ নেই। এ যুগে কোন কীর্তি ও কর্ম রেখে যেতে হলে এবং প্রতিভা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি পেতে হলে আরো ব্যাপক ও বি¯তৃত জ্ঞান-গবেষণা ও ইলমী সাধনার প্রয়োজন। কেননা সময়ের কাফেলা অনেক পথ পাড়ি দিয়ে চলে গেছে অনেক সামনে। পূর্ববর্তীদের রেখে যাওয়া জ্ঞান-সম্পদ অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযোগ্য। এর সাথে জড়িয়ে আছে মূল্যবান স্মৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য। এগুলো এখন আমাদের অস্তিত্বেরই অংশ। কিন্তু সময় বড় নির্দয়। যামানা বড় বে-রহম। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যত বিশাল হোক, প্রতিভার প্রভা যত সমুজ্জ্বল হোক এবং জামাত ও সম্প্রদায় যত ঐতিহ্যবাহী হোক সময় কারো সামনেই মাথা নোয়াতে রাজি নয়। যুুগের স্বভাবধর্ম এই যে, যোগ্যতার দাবিতে স্বীকৃতি আদায় না করলে আগে বেড়ে সে কাউকে স্বীকার করে না।
কোন কিছুর ধারাবাহিকতা বা প্রাচীনতা সময়ের শ্রদ্ধা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। সময় এমনই বাস্তববাদী, এমনই শীতল ও নিরপেক্ষ যে, তার হাতে নতুন কিছু তুলে না দিলে এবং তার ঘাড়ে ভারী কোন বোঝা চাপিয়ে না দিলে সে মাথা নোয়াতে চায় না। সময়ের স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি লাভ করা এত সহজ নয় এবং শুধু ঐতিহ্যের দোহাই যথেষ্ট নয়। সুতরাং সময়ের স্বীকৃতি পেতে হলে, ব্যক্তিত্বের প্রভাব বিস্তার করতে হলে এবং আত্মগর্বী সমাজের মন-মগজে যথাযোগ্য স্থান পেতে হলে প্রতিভা ও যোগ্যতার আরো বড় প্রমাণ দিতে হবে এবং ব্যক্তিত্বের উচ্চতা আরো বাড়াতে হবে, যে উচ্চতা ছাড়িয়ে যাবে হিমালয়ের শৃঙ্গকে।
আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে সমান গুরুত্বের সাথে। তা এই যে, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি এখন যদিও উৎকর্ষের চরমে পৌঁছে গেছে এবং চিন্তা-গবেষণার বহু নতুন ক্ষেত্র তৈরী হয়ে গেছে, সর্বোপরি তার গুরুত্ব ও ব্যাপকতা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে মানবজাতির জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে বেশ কিছু সমস্যা ও জটিলতারও সৃষ্টি হয়েছে। সময় এখন এমন নতুন মোড় পরিবর্তন করেছে এবং এমন সব উলট-পালট ও বিপ্লব দেখা দিয়েছে যে, শুধু জ্ঞানের ব্যাপ্তি, চিন্তার উচ্চতা, মতবাদের অভিনবত্ব এবং লেখার যাদু এখন সময়ের ‘আশির্বাদ’ ও যামানার নেক নজর লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। সেই সঙ্গে এখন প্রয়োজন উন্নত চরিত্রের, দরদি হৃদয়ের এবং অশ্রুভেজা চোখের। হয়ত এ কথা আপনাদের কাছে মনে হবে অবাস্তব। হয়ত বলা হবে যে, এ বক্তব্যে সময়ের চরিত্রের সঠিক চিত্র নেই। কেননা সাদা চোখে দেখা যায়, এককালে যে সকল আদর্শ ও মূল্যবোধ আমাদের প্রাণপ্রিয় ছিল এবং যে সকল নীতি ও বিধান শরীয়তের ‘প্রাপ্য’ ছিল আধুনিক যুগ সে সবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আওয়াজ তুলেছে। সুতরাং মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, হৃদয়ের ও চরিত্রের এবং দরদের ও অশ্রুজলের এখন আর তেমন মূল্য নেই।
কিন্তু এ ধারণা ভুল। কেননা সব কিছুর পরও একথা সত্য যে, মহৎ ব্যক্তিত্বের প্রতি, উন্নত চরিত্রের প্রতি এবং কর্মের শুভ্রতার প্রতি সমাজ ও মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দুর্বল হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েই চলেছে। যে কোন সংস্কার ও বিপ্লবের পিছনে প্রাণপুরুষ রূপে আপনি এমন কোন কোন ব্যক্তিকে অবশ্যই দেখতে পাবেন যিনি তার বিপুল সংখ্যক সাথী ও অনুগামীকে আপন ব্যক্তিত্ব দ্বারা প্রভাবিত করেছেন, তাদের চিন্তায়, চেতনায় এবং ভাব ও ভাবনায় পরিবর্তন এনেছেন এবং তাদের মাঝে এক নতুন চিন্তাধারা সৃষ্টি করেছেন। মোটকথা গুণসমৃদ্ধ কোন ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করেই নতুন আদর্শের এবং নতুন বিপ্লবের আবির্ভাব ঘটেছে।
যে কোন বিপ্লবের গোড়ায়, যেখান থেকে বিপ্লবের নতুন স্রোতধারা উৎসারিত হয় এবং দেশ ও সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে সেখানে অবশ্যই আপনি একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব দেখতে পাবেন, বিশ্বাসের শিকড় যার হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত এবং বিপ্লবের চেতনায় মন-মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন। বিশ্বাসের এই গভীরতা এবং চেতনার এই আচ্ছন্নতা তার ব্যক্তিত্বে চৌম্বুক শক্তি ও বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দূর থেকে আকৃষ্ট করে কাছে টেনে আনে। শুধু বক্তৃতা ও বাগ্মিতা, শুধু কলমের ধার ও ভার, শুধু চিন্তার চমক ও গবেষণার চটক এবং শুধু মনীষা ও জ্ঞানবৈদগ্ধ দ্বারা যুগ ও সমাজের বুকে নতুন বিপ্লব সৃষ্টি করা যায় না। বিপ্লব তো বড় কথা, সাদামাটা পরিবর্তনও আনা যায় না। সুতরাং নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এ যুগে আরো বেশি প্রয়োজন উন্নত চরিত্রের, হৃদয় ও আত্মার সুতীব্র দহনের এবং এমন তাপ ও উত্তাপের যা ভিতরে ভিতরে জন্ম দেয় প্রবল এক আগ্নেয়গিরির, যার লাভা উদ্গীরণ সমাজের বিদ্যমান সব জঞ্জাল মুহূর্তে ভস্মীভূত করে এবং লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয় একইভাবে উত্তপ্ত করে। আজ দরকার সেই রকম কিছু মানুষের, কিছু জীবন্ত হৃদয়ের এবং কিছু অশ্রুসিক্ত চোখের। আর সেজন্য সময় ও সমাজ তাকিয়ে আছে আপনাদের পানে ব্যাকুল দৃষ্টিতে। কারণ মখমলের গালিচার অভাব নেই, অভাব খেজুর পাতার ছিন্ন চাটাইয়ের।
লেখক : সহকারী সম্পাদক
মাসিক আর রাশাদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন