শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই পানি নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ: ওয়াসার পানি কোথাও কালো, কোথাও লালচে এবং দুর্গন্ধযুক্ত। বিবর্ণ ও দুর্গন্ধময় পানি পানের তো প্রশ্নই আসে না, বাসনকোসন ও কাপড়চোপড় ধোয়া এবং গোসল বা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করাও সম্ভব নয়। ওয়াসার কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। এমতাবস্থায়, অনেকেই খাবার পানি কিনে পান ও ব্যবহার করছে। যাদের এ সামর্থ্য নেই তারা ওয়াসার বিভিন্ন পাম্প থেকে পানি সংগ্রহ করছে। ওয়াসার পানি ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধযুক্ত এবং পান ও ব্যবহারের অযোগ্য, এটা কোনো নতুন খবর নয়। প্রতি বছরের বিশেষ করে শুষ্ক মওসুমের এটি একটি সাধারণ খবর। এ ব্যাপারে ওয়াসার যে বক্তব্য তাতেও কোনো নতুনত্ব নেই। তার পক্ষ থেকে একই কথা বারবার বলা হয়। ওয়াসার পানির একটা উল্লেখযোগ্য উৎস হলো বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানি। এ পানি শোধন করে সরবরাহ করা হয়। বলা হয়, শুষ্ক মওসুমে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানি কমে যায়। এ অবস্থায় যে পানি পাওয়া যায় তা অধিকতর ময়লা-আবর্জনাযুক্ত। শোধন করেও পানি পানযোগ্য করা কঠিন। এ জন্য অধিক মাত্রায় পরিশোধক ব্যবহার করতে হয়। এতেও অনেক সময় পানি স্বচ্ছ ও দুর্গন্ধমুক্ত হয় না। আরও একটি বক্তব্য দেয়া হয়। বলা হয়, পানির সরবরাহ লাইনগুলো পুরনো। অনেক স্থানেই লাইনে ছিদ্র সৃষ্টি হয়েছে, কিংবা সংযোগস্থল আলগা হয়ে গেছে। এ কারণে সরবরাহকৃত পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা মিশে তার পান ও ব্যবহারযোগ্যতা নষ্ট করে দেয়। কখনো কখনো এই অভিযোগও করা হয়, ওয়াসার পানি ঠিকই আছে। পানিতে ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধের কারণ দীর্ঘদিন পানির ট্যাংকি পরিষ্কার না করা। জানা গেছে, দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীতে নতুন পানির লাইন বসানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে লাইনের জরাজীর্ণতা বা ছিদ্রির কারণে পানি দূষিত হওয়ার কথা নয়। তারপর নিম্নমান ও দুর্গন্ধময় পানি পাওয়া যাচ্ছে কেন, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।
বিশাল রাজধানী শহরে পানি সরবরাহের একমাত্র সরকারি সংস্থা ঢাকা ওয়াসা। পান ও ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের দায়িত্ব এই সংস্থার ওপর। ওয়াসার পানির বিশুদ্ধতা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন আছে। আজও এই প্রশ্নের কোনো সুরাহা হয়নি। এমন অনেক শহর ও দেশের কথা জানা যায়, যেসব শহর ও দেশে সরবরাহকৃত পানি কোনোরূপ পরিশোধন বা ফোটানো ছাড়াই পান করা যায়, ব্যবহার করা যায়। ঢাকা ওয়াসা তার পানির ব্যাপারে এই নিশ্চয়তা দিতে আজও পারেনি। পারবে, এমন সম্ভাবনাও কম। পানির চাহিদা ক্রমবর্ধমান। ওয়াসা এই চাহিদা পূরণে সক্ষম নয়, এত দিন আমাদের সেটাই জানা ছিল। এখন জানা যাচ্ছে, চাহিদা পূরণের সক্ষমতা নাকি ওয়াসা অর্জন করেছে। রাজধানীতে তার গ্রাহকসংখ্যা প্রায় চার লাখ। তাদের চাহিদা দৈনিক ২৩০ থেকে ২৩৫ কোটি লিটার। ওয়াসা বর্তমানে ২৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করতে পারে। এই হিসাবে অন্তত ১০ কোটি লিটার পানি অতিরিক্ত থাকার কথা। আছে কি? এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া মুশকিল। ওয়াসার মতে, উৎপাদিত পানির ২০ শতাংশ সিস্টেম লস হয়ে যায়। পানির অবৈধ সংযোগ কত আছে এবং তাতে কি পরিমাণ পানি চলে যাচ্ছে তার হিসাবটাও জানা দরকার। বলাই বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁক বা ফাঁকি আছে। হিসাবপত্রে পানির ঘাটতি নেই; বাস্তবে ঘাটতি আছে। এ ব্যাপারে গ্রাহকরাই উপযুক্ত সাক্ষ্য দিতে পারবে।
যেহেতু রাজধানীতে পানি সরবরাহের দ্বিতীয় বা বিকল্প কোনো সংস্থা নেই, সুতরাং ঢাকা ওয়াসাকেই রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করতে হবে এবং অবশ্যই সে পানি হতে হবে মানসম্পন্ন ও বিশুদ্ধ। শুষ্ক মওসুম সবে শুরু হয়েছে। আগামীতে পানির অভাব বা সঙ্কট দেখা দিতে পারে। সেদিকে যেমন খেয়াল রাখতে হবে তেমনি রাজধানীর যে সব এলাকা থেকে পানির মান নিয়ে, বিশুদ্ধতা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, সেসব এলাকায় সরেজমিন তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কথা কারো অজানা নেই, ওয়াসার পানির প্রধান উৎস গভীর নলকূপ। গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভ‚গর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করে গ্রাহকদের মধ্যে সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানি বিশুদ্ধ ও পানযোগ্য। কিন্তু ওয়াসার সিস্টেমের মধ্যে এলেই তা আর বিশুদ্ধ ও পানযোগ্য থাকে না। সিস্টেমগত ও অন্যান্য কারণে পানি অবিশুদ্ধ হয়ে পড়ে। এটা দেখতে হবে এবং গোটা সরবরাহ ব্যবস্থাকে নবরূপে বিন্যাস করতে হবে যাতে সরবরাহকৃত পানির বিশুদ্ধ অক্ষুণœ থাকে। দ্বিতীয়ত, নদীর পানি পরিশোধনের মাধ্যমে সরবরাহ করার যে ব্যবস্থা আছে, সেই ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। শোধন প্রক্রিয়া থেকে সরবরাহ পর্যন্ত পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। এসব ব্যাপারে ওয়াসা যথাযথ মনোযোগ দেবে, উচ্চ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে, এটাই কাম্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন