অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কথিত সার্চ কমিটির সুপারিশে গঠিত নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক থাকলেও কেউই এই কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করেনি। বিশেষত, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অতীত কর্মকান্ড ও রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকা সত্তে¡ও বিরোধীদল বিএনপি মূলত নির্বাচনকালীন সরকারের প্রতি বেশী গুরুত্ব আরোপ করতে চাইছে। সেই সাথে সম্ভবত তারা নতুন নির্বাচন কমিশনের কর্মকান্ডও নিরীক্ষণ করতে আগ্রহী। ফেব্রুয়ারীতে নির্বাচন কমিশনের শপথ গ্রহণের পর থেকে এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচন হিসেবে দেশের ৭টি বিভাগের ১৪টি উপজেলা ও ৪টি পৌরসভা নির্বাচনে কমিশনের ভূমিকা ও নির্বাচনের মানকে সর্বমহলের পক্ষ থেকেই কমিশনের জন্য প্রথম পরীক্ষা হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। অবশেষে ৬ ফেব্রুয়ারীর সেই নির্বাচনটি অতিবাহিত হয়েছে। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নৌকা ও ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার পরও ভোটের দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভোটারশূন্য দেখা গেছে বেশীরভাগ ভোটকেন্দ্র। এ যেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর একপাক্ষিক ভোটারবিহীন নির্বাচনেরই একটি খন্ডিত পুনরাবৃত্তি। একইভাবে আগের মতই ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা জালভোট ও প্রকাশ্য নৌকায় সিল মারা নির্বাচনী সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে এই নির্বাচনে। বহুল বিতর্কিত সদ্য বিদায়ী রকিব কমিশনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশন সচিব তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ভোটার কম, তবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
বাংলাদেশের সাধারণ ভোটাররাও রাজনীতি সচেতন। বিশেষত, স্থানীয় নির্বাচনগুলো সব সময়ই জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসবমুখর হয়ে উঠতে দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়া অথবা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে একপাক্ষিক সিলমারা নির্বাচনের সংস্কৃতি চালু করে নির্বাচনের সেই উৎসবমুখরতার ঐতিহ্যকে অনেকটাই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তবে বিগত নির্বাচন কমিশনারের সর্বশেষ সফল নির্বাচন হিসেবে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকে উৎসবমুখর ও ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জাতির মধ্যে একটি নতুন প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। কয়েকটি উপজেলায় উপনির্বাচনসহ এই দফার স্থানীয় নির্বাচনগুলো জাতীয়ভাবে তেমন গুরুত্ববহন না করলেও নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচন হিসেবে এই নির্বাচনকে নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইতিবাচক টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করায় এর একটি বাড়তি গুরুত্ব ছিল। সরকারী দলের প্রার্থী ও কর্মীদের জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগে কয়েকটি স্থানে বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং জালভোট দেয়ার অভিযোগে সরকারী দলের কয়েকজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত কারাদন্ড দিলেও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল গতানুগতিক। ভোটকেন্দ্রগুলো দিনভর ভোটারবিহীন থাকার পাশাপাশি জালভোট, বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া এবং প্রকাশ্য সিল মারার সংবাদগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও নির্বাচন কমিশনকে কোন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনীতিতে সহিংসতা, দুর্বৃত্তায়ন তথা অপরাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দেশের নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছে বলে একাধিক জরিপ রিপোর্টে জানা গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, দেশের সাধারণ ভোটাররা নির্বাচন তথা নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা বা অনাগ্রহী হয়ে পড়ছে। ছয় মার্চে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটার স্বল্পতার কারণ অনুসন্ধানে ইনকিলাব প্রতিনিধির পাঠানো রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী জাতীয় নির্বাচনটি ভোটারবিহীন ও একতরফা হওয়ার পর থেকে দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে পরবর্তী প্রায় সবগুলো স্থানীয় নির্বাচন প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ বা অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় জনগণ ভোটদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এটি মূলত আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি সাধারণ ভোটারদের অনাস্থার ফল। বিগত দশম জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার ত্রুটি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়ে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রæতি দিচ্ছেন। নতুন নির্বাচন কমিশনও সরকার বা কোন রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম স্থানীয় নির্বাচনে কমিশনের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন দেখা যায়নি। নির্বাচনী অপসংস্কৃতির কারণে ভোটদানে ভোটারদের অনাগ্রহ দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে নিতে হবে। বিপুল সংখ্যক ভোটারের অনুপস্থিতিতে নির্বাচনের ফলাফলকে জনমতের প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠাই সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিতব্য স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে সুষ্ঠু পরিবেশ এবং জনমতের প্রতিফলনের উপর একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সামগ্রিক অর্থে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের ভিত রচিত হতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন