প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে বড় প্রতিরক্ষাচুক্তি করতে দিল্লী জোর তৎপরতা চালাচ্ছে বলে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত ২৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশে অস্ত্র (মিলিটারি হার্ডওয়ার) বিক্রি করতে চাইছে। এই চুক্তি হলে ভারত অস্ত্র কেনার শর্তে বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ (লাইন আব ক্রেডিট) দেবে- যা দিয়ে ভারত থেকে অস্ত্র কিনতে হবে। হিন্দুস্থান টাইমস এ সংক্রান্ত খবরে বলছে, গত নভেম্বরে চীনের কাছ থেকে দু’টি সাবমেরিন কেনায় বাংলাদেশের উপর ক্ষুব্ধ ভারত। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় বলা হয়েছে, আসন্ন সফরে যেভাবেই হোক প্রতিরক্ষা চুক্তিতে হাসিনাকে সই করানোর চেষ্টায় ভারত। এই চুক্তি সম্পাদন হলে এটাই হবে কোন দেশের সাথে নয়াদিল্লীর সবচেয়ে বড় আকারের প্রতিরক্ষা চুক্তি। অনুচুক্তি বা সমঝোতা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে যৌথ সহযোগিতায় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করবে। এছাড়া সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ আরো নিবিড় হবে। বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির আরো বাড়ানো হবে। গত কয়েক বছর ধরে দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে চলমান যৌথ মহড়ার পরিধি আরো বাড়ানো হবে।
ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপের মালিকানাধীন গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে চীনের প্রভাব থেকে মুক্ত করাই এপ্রিলে শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের মূল বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্র আরো বৃদ্ধি পেতে চলছে বলে প্রকাশিত খবরাদিতে নিশ্চিত করা হয়েছে। এই সফরের সময়ে দুই দেশের মধ্যে একাধিক সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে এবং এ লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে তার রূপরেখো চূড়ান্ত করণের কাজ চলছে বলেও বলা হয়েছে। তবে সহযোগিতার চরিত্র নিয়ে দুই দেশের মধ্যে অবশ্য এখনো কিছু কিছু বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ভারত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পক্ষে হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে বাংলাদেশ তেমন কিছু চায় না। এমনকি ‘প্রতিরক্ষা চুক্তি’ শব্দ যুগল নিয়েও আপত্তি রয়েছে। বিষয়টিকে তারা বরং সমঝোতা স্মারকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী। দেশীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশ এমন কোন ধারণার সৃষ্টি করতে চায়না যে দেশটি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের উপর নির্ভরশীল হতে যাচ্ছে। বলা হয়েছে, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর বাংলাদেশ সফরের সময় এই সুসংহত চুক্তির প্রস্তাব করছিলেন। পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্করের সফরের সময়ে বিষয়টিকে সমঝোতা স্মারকের পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। যৌথ সহযোগিতায় বাংলাদেশের জন্য কোন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন করা হবে সে বিষয়ে অবশ্য স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। বাংলাদেশের একটি সরকারি সূত্র অনুযায়ী ভারতীয় নেতৃত্বকে বাংলাদেশ এটুকুু বুঝিয়ে দিয়েছে- একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে তারা সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তার করবে। এ ক্ষত্রে তারা অন্য কোন দেশের সঙ্গে তুলনীয় হতে চায় না। প্রকৃত প্রস্তাবে এটা বলা যায়, আসন্ন সফরকে কেন্দ্র করে হয়ত অনেক দিন থেকেই দু’দেশের মধ্যে নানা কথাবার্তা হচ্ছে । হয়ত এ কারণেই প্রধানমন্ত্রীর সফর বিলম্বিত হয়েছে। সে বিবেচনায় আসন্ন সফর যে অত্যন্ত স্পর্শকাতর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃত বিবেচনাতেই এই সফরে যেসব চুক্তি নিয়ে কথা উঠেছে তার সাথে জাতীয় স্বার্থের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের সাথে এর আগেও ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি ছিল যা শেখ হাসিনা নবায়ন না করার মধ্যদিয়ে বাতিল হয়েছে। তার চেয়েও বড় শর্তের বেড়াজালে এবারে যে চুক্তি করতে চাচ্ছে ভারত, তার জন্য একটি মোক্ষম সময় তারা বেছে নিয়েছে। সামনে নির্বাচনকে টোপ হিসেবে দিয়ে যে ধরনের চুক্তির কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই সরকারের অভ্যন্তরেই মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে সার্বভৌমত্বের। সংগত বিবেচনা থেকেই বলা যায়, নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশের জনগণের সাথে কোন বিবেচনাতেই সৎ প্রতিবেশীর আচরণ করছে না। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা যায়নি, পানির ন্যায্য হিস্যা পাবার কোন ব্যবস্থা হয়নি, এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা হবার পরেও তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে কার্যকর কোন অগ্রগতি নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে ভারতকে যতটা দিয়েছে দিচ্ছে তার সিকিভাগও আনতে পারছে না। এসময়ে বাংলাদেশ ভারতের স্বার্থে অনেক বড়বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। সীমান্তে ভারত বিরোধী বিদ্রোহী দমনসহ কানেকটিভিটি চুক্তি করে ভারতকে অনেক সুযোগ করে দিয়েছে।
প্রকৃত বিবেচনাতেই ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে তৎকালীন ভারতীয় কংগ্রেস সরকারের অনৈতিক সমর্থনের মধ্যদিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। প্রতিটি দেশের প্রতিরক্ষা চুক্তির সাথে অনেক মৌলিক বিষয়ের সম্পর্ক রয়েছে। আলোচ্য ক্ষেত্রেও সহযোগিতা সমঝোতার মধ্যবর্তী যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলোকে কোন বিবেচনাতেই খাটো করে দেখা যাবে না। এ ধরনের চুক্তি করার আগে অবশ্যই জনমতের প্রতিফলন বিবেচনায় নেয়া অত্যন্ত জরুরি। সাধারণভাবে সংসদকে বিবেচনায় নেয়ার যে বিষয়টি এসব ক্ষেত্রে থাকে বর্তমান সময়ে তার অবকাশ অত্যন্ত কম। ú্রতিটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা থাকতে হয়। এর অর্থ জাতীয় স্বাধীনতা অক্ষুণœ রেখেই তা করতে হয়। দেশে বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তির মত স্পর্শকাতর চুক্তি সম্পাদন কতটা যুক্তিসংগত হবে সেটা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখবেন। যা কিছুই হোক, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে জাতীয় স্বার্থের প্রতি আঘাত বলে বিবেচিত হতে পারে এমন কোন ধরনের চুক্তিতে উপনীত না হওয়াই হবে বাঞ্ছনীয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন