শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিমানবন্দর কি মগের মুল্লুক

প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বিমান যেন কোনোভাবেই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারছে না। এর যেন কোনো মা-বাবা নেই। মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রী থাকার পরও তাদের কোনো আদেশ-নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না। বিমানবন্দরের সরকার সমর্থিত শক্তিশালী সিবিএ সিন্ডিকেটচক্রের কাছে তারা অনেকটা অসহায়। এ চক্র তাদের ইচ্ছামতো বিমান ও বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ করছে। বিমান কখন ছাড়বে, তাও তাদের খেয়াল খুশির উপর নির্ভর করছে। কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। পুরো বিমানবন্দর অচল করে দেয়াসহ আন্দোলনের হুমকি দেয়া হয়। সার্বিক পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, বিমান ও বিমানবন্দর এখন সিবিএ নেতাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর সচল থাকা না থাকা নির্ভর করছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবসহ সহযোগী একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বিমান ও বিমানবন্দরের বেশুমার দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। সরকারী কার্যদিবসে বিমানের গ্রাউন্ড সার্ভিস ইকুইপমেন্ট শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পিকনিক করায় পুরো গ্রাউন্ড সার্ভিস ভেঙ্গে পড়ে। এ ঘটনায় বিমান ম্যানেজমেন্ট ট্রাফিক ও জিএসই বিভাগের দুই কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সিবিএ নেতারা বিমানের সব ফ্লাইট দেরিতে ছাড়তে বাধ্য করেন। সিবিএ নেতাদের হুমকি-ধমকি ও ফ্লাইট দেরিতে ছাড়ার খবর পেয়ে গত বৃহস্পতিবার বিমানবন্দরে ছুটে যান বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী। সিবিএর হুমকির মুখে তারা নতি স্বীকার করে বিমান ম্যানেজমেন্টকে দুই সিবিএ নেতার শোকজ প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন। এতে বিমানজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। শুধু এবারই নয়, কিছুদিন আগে বিমানের একজন শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিমানমন্ত্রী ও সচিবের নির্দেশে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি বিমান ম্যানেজমেন্ট। এসব ঘটনা থেকে মনে হয়, বিমান ও বিমানবন্দরের উপর বৈধ কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সবকিছু একশ্রেণীর সিবিএ নেতার কতৃত্বে চলছে এবং তারা যা খুশি তা করে বেড়াচ্ছেন।
বিমান আমাদের অন্যতম গর্বের একটি ক্ষেত্র। বাংলাদেশের পতাকা বহনকারী একমাত্র আন্তর্জাতিক এয়ার লাইন। এটি শুধু একটি যোগাযোগ মাধ্যমই নয়, সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাম ছড়িয়ে দিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের এই গর্বকে ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে এর কিছু লোকের নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। এ নিয়ে বহু লেখালেখি এবং বিমান ও বিমানবন্দরকে আধুনিক ও বিশ্বমানের করার তাকিদ দেয়া হলেও তার ছিটেফোটা প্রভাবও পড়েনি। আমরা দেখছি, খাতটিকে একটি দুর্নীতি ও লুটপাটের ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বিমান লোকসানী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলছে। এর সেবার মান বৃদ্ধি দূরে থাক, যাত্রীদের প্রতি পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এর অনিয়ম কতটা বিস্তৃত হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন না করে বনভোজন করতে চলে যায় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আবার শোকজ করলে নানা কৌশলে ফ্লাইটের সিডিউল ওলট-পালট করাসহ পুরো বিমানবন্দর অচল করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়! মন্ত্রীকেও বাধ্য হয়ে শোকজ প্রত্যাহারের নির্দেশ দিতে হয়! বিশ্বের আর কোথাও এমন নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে কিনা, আমাদের জানা নেই। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বিমান ও বিমানবন্দরকে সিবিএ চক্র তাদের পৈত্রিক সম্পদ ভেবে বসেছে এবং যেভাবে খুশি সেভাবে পরিচালনা করছে। বিমান ও বিমানবন্দরকে মগের মুল্লুকে পরিণত করেছে। তাদের এই অপকর্ম ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার যেন কোনো শক্তি নেই। শক্তি যে নেই তার প্রমাণ তো পাওয়া গেল দুই সিবিএ নেতার বিরুদ্ধে শোকজ করেও তা প্রত্যাহার করতে মন্ত্রীর বাধ্য হওয়া থেকে। এর ফলে যা হলো তা হচ্ছে, অন্যায় করে অন্যায়কারী প্রশ্রয় পেয়ে গেল এবং আরও বেশি অন্যায় করার সাহসও পেল। তারা বুঝিয়ে দিল তাদের স্পর্শ করার মতো কেউ নেই। কোনো দেশের বিমান ও বিমানবন্দরে যদি এ পরিস্থিতি বিরাজ করে, তবে সে দেশের এয়ার লাইন উন্নত হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এর মাধ্যমে দেশের বদনাম ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিমান আন্তর্জাতিক পরিবহন হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোকের এর যাত্রী হওয়া স্বাভাবিক। বিদেশী যাত্রীরা যদি দেখে টাইম সিডিউলসহ বিমানে যথাযথ সেবা পাওয়া যাচ্ছে না এবং হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, তবে নিশ্চয়ই তারা এর প্রশংসা করবে না। বলাবাহুল্য, আমাদের দেশের অনেক যাত্রীই বিমানের অব্যবস্থাপনা ও হয়রানিতে অতিষ্ঠ হয়ে অন্য এয়ারলাইন বেছে নেয়। অর্থাৎ বিমান যেখানে নিজের দেশের যাত্রীই ধরে রাখতে পারছে না, সেখানে বিদেশের যাত্রী আকৃষ্ট করবে কিভাবে? এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে, বিমানের লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া দূরে থাক উল্টো রাষ্ট্রের বোঝায় পরিণত হবে।
বাংলাদেশ বিমান ও বিমানবন্দরকে এখন অনেকে সায়েদাবাদ, সদরঘাটসহ অন্যান্য টার্মিনালের সাথে তুলনা করেন। যেখানে নিয়ম-শৃঙ্খলার তেমন কোনো বালাই নেই। পদে পদে যাত্রী হয়রানি ও অব্যবস্থাপনা শিকড় গেঁড়ে রয়েছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যমের এমন দুর্গতিকে অত্যন্ত লজ্জার এবং দুঃখজনক বলা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! কিছু লোকের ব্যক্তিস্বার্থ ও খেয়ালখুশির কাছে পুরো বিমান জিম্মি হয়ে পড়া এবং তা সয়ে যাওয়া অকল্পনীয় ও দুর্ভাগ্যের বিষয়। অন্যায় যে করছে এবং তাকে যেভাবে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে, তা কি দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল নয়? আমরা জানি না, এ পরিস্থিতি আর কতকাল চলবে। আমরা শুধু এ প্রত্যাশাটুকুই করতে চাই, যারা এবং যাদের কারণে বিমান ও বিমানবন্দর জিম্মি হয়ে পড়ে, তারা যেই হোক, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি দেয়া হোক। এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড়া দেয়া চলবে না। বিমান ও বিমানবন্দরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ যাত্রীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে যা করার প্রয়োজন, তাই করতে হবে। বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা চলতে দেয়া যাবে না। দেশের ভাবমর্যাদা ও অর্থনৈতিক স্বার্থে বিমান ও বিমানবন্দরে অবশ্যই আন্তর্জাতিক পরিবেশ সৃষ্টি ও বজায় রাখতে হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন