অনেক ছাড় দিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট হলেও এ দেশের জনগণ ভারতের পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া তথাকথিত প্রতিরক্ষা চুক্তি চায় না। বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন সামরিক-অর্থনৈতিক মেরুকরণের ফলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবেও তার গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখে ভারত বাংলাদেশের সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা চুক্তি করার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই চাপ সৃষ্টি করছে বলে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত খবরাদিতে জানা গেছে। আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরকে ঘিরে এই আলোচনা এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। একাত্তুরের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে প্রবাসী সরকারের সাথে ৭ দফা চুক্তির শর্ত অনুসারে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ দিল্লীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধী যে ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি করেছিলেন তা’ পরবর্তীতে দেশের মানুষের কাছে একটি গোলামী চুক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। সেই চুক্তির মেয়াদ ১৯৯৭ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারত অনুরূপ আরেকটি চুক্তির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেও বাংলাদেশ কখনোই এ ধরনের চুক্তিতে আগ্রহী নয়। নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছে দাসখত দেয়া বাংলাদেশের জনগণ এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মেনে নেয়নি, কখনো মেনে নেবে না। স্বাধীনতার পর সাড়ে চার দশক পেরিয়ে এসে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ যথেষ্ট শক্তিশালী ও অগ্রসরমান। দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বিশ্বশান্তি রক্ষায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এই পররাষ্ট্রনীতি ধারণ করে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী সব রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মার্কিন গোয়েন্দা দফতর (সিআইএ)’র রিপোর্ট অনুসারে ‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’ (জিএফপি) নামক একটি প্রতিরক্ষা বিষয়ক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার চতুর্থ এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ১৮তম সামরিক শক্তিধর দেশ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বের ১২৬টি দেশের মধ্যে সামরিক শক্তিতে বাংলাদেশ ৫৩তম হলেও ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী বলেই মনে করেন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ভারত মহাসাগর এবং দক্ষিণ চীনসাগরে সামরিক-অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে চীন, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত পরাশক্তিগুলো জড়িয়ে পড়ায় কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ সকলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একইভাবে বাংলাদেশও সকলের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তার অবস্থান ক্রমশ শক্তিশালী ও সুসংসহত করে চলেছে। বাংলাদেশ শক্তিশালী হওয়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ বিরোধী লড়াই এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের নামে ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর শান্তি ও অখন্ডতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে। সেই সাথে বঙ্গোপসাগরের বিশাল পানিসীমা এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো বাংলাদেশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সার্ক ও বিমসটেকের এজেন্ডা অনুসারে আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ যেমন ভারত-পাকিস্তানসহ নিকটতম প্রতিবেশীদের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একইভাবে চীনের সাথেও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক, সামরিক ও কৌশলগত নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। ভারত যেমন আমেরিকা, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনে থাকে তেমনি বাংলাদেশও চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার কাছ থেকেও সামরিক সরঞ্জাম কিনে থাকে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ‘পার্টনারশিপ ডায়ালগ’ রয়েছে। এ সকল বিষয়ে দীর্ঘদিনে বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান তৈরী করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য দু’টি সাবমেরিন সংগ্রহ করার পর বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে তার যাত্রা শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতমাসে কক্সবাজারে রামু সেনানিবাসে নবপ্রতিষ্ঠিত ৭টি ইউনিটের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিশ্বের অন্যতম সেরা সেনাবাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়দীপ্ত ঘোষণা দেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের এমন বক্তব্যে পুরো জাতি আশ্বস্ত ও আশান্বিত হয়। তবে গত নভেম্বরে চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন ডেলিভারি গ্রহণের পর ভারতের পক্ষ থেকে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এবং কথিত সামরিক চুক্তিসহ ভারত থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তির প্রস্তাবকে দেশের কোন পক্ষই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীকে বিশ্বের সর্বাধুনিক ও শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলেও ভারতীয়রা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভারত নির্ভর বা ভারতমুখাপেক্ষী বাহিনীতে পরিণত করতে চাইছে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন। মৈত্রী চুক্তির নামে ইতিপূর্বেকার ২৫ বছরের অধীনতাচুক্তি এবং ভারতের সাথে শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা চুক্তির তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। বিএনপিসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা একযোগে ভারতের সাথে জাতীয় স্বার্থবিরোধী প্রতিরক্ষা চুক্তি জনগণ মানবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। প্রতিরক্ষাচুক্তি, এমওইউ বা সমঝোতা কোন ফর্মেই এ ধরনের চুক্তি কাম্য নয়। দেশে যতই রাজনৈতিক বিভাজন থাকুক কথিত নিরাপত্তা চুক্তির বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যেই এক ধরনের মতৈক্য তৈরী হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কোন বিতর্কিত প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সম্মত হবেন, এমনটা কেউ মনে করেন না, প্রত্যাশা করেন না। সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী সফর কয়েক দফা পেছানোর মধ্য দিয়ে বোঝা গেছে, এ বিষয়ে এ প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা, শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনের কাজে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি এমন কোনো চুক্তি করবেন না যাতে দেশের স্বার্থ ক্ষুণœ হয়, প্রতিরক্ষা দুর্বল ও অনিশ্চিত হয় এবং দেশ কোনো শৃঙ্খলে আটকে পড়ে। তিনি জনগণকে সাথে নিয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত নেবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন