সড়ক-মহাসড়ক দিনের বেশীরভাগ সময় যানজটে স্থবির হয়ে থাকলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, জনজীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি অসম্ভব। অর্থনৈতিক খাতে সরকার যতই পরিসংখ্যানগত প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নের উল্লেখ করুক, রাজপথ ও জনজীবনে উন্নয়নের কোন লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণের পরও ঢাকার রাজপথে যানজট ও জনদুর্ভোগ উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। শহরের মূল প্রবেশপথগুলোতে প্রতিদিনই দীর্ঘ যানজট লেগেই থাকছে। ঢাকার বাইরে ছোটবড় প্রতিটি শহর এবং মহাসড়কেও মাইলের পর মাইল লম্বা যানজটের খবর পাওয়া যায়। আর এসব যানজটের নানাবিধ কারণের অন্যতম হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের বেপরোয়া চাঁদাবাজি। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চালক, গণপরিহনের চালক-মালিক, প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিক্সা চালক থেকে শুরু করে রিক্সাচালকরা পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজিতে অতীষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এর ফলে একদিকে শহর ও মহাসড়কের প্রতিটি ট্রাফিক পয়েন্টে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে ট্রাফিক পুলিশের কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজির মাশুল-ভাড়া ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে জনগণের উপরই চাপানো হচ্ছে।
রাস্তায় যানজট সৃষ্টির নানাবিধ অনুষঙ্গের মধ্যে অপ্রশস্ত ও চলাচলের অনুপযোগী রাস্তা, ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ি, একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচলের সুযোগ এবং আনাড়ি ও অদক্ষ গাড়ি চালকদের যত্রতত্র যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং এবং যাত্রী ও পণ্য ওঠা-নামা করানোর মত বিষয়গুলো রয়েছে। রাস্তায় যানজট সৃষ্টিকারী এবং চলাচলের গতি মন্থরকারী এসব প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাকে সচল ও নিরাপদ রাখাই ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের মূল দায়িত্ব হলেও তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে যত্মবান হওয়ার বদলে গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের ত্রুটি-বিচ্যুতির বিষয়গুলোকে নিজেদের চাঁদাবাজির সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করছে। বিভিন্ন রুটে গণপরিবহনের ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের কাছ থেকে মাসোহারা হিসেবে লাখ লাখ টাকার সমঝোতার কারণে এসব গাড়ি তেমন বিড়ম্বনার শিকার না হলেও কাগজপত্র পরীক্ষা এবং নানা অজুহাতে পণ্যবাহী ট্রাক, লরি, পিক-আপ ভ্যান এবং প্রাইভেট কার আটকে চাঁদাবাজির ঘটনা সকলের কাছে সহনীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। মাসোহারা বা নিয়মিত চাঁদার লেনদেনের বাইরে থাকা গাড়ির চালক-মালিকরা পার্কিং আইন না মানা, গাড়ির ডেন্টিং ত্রুটি বা এ জাতীয় তুচ্ছ ঘটনায়ও গাড়ি আটক করে, রেকার লাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে হাজার হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। দিনের বেলায় ঢাকা শহরে পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় সন্ধ্যার পর পর শহরের প্রবেশপথগুলো ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজির হাটে পরিণত হতে দেখা যায়। যানজট দূর ও গণপরিবহনের যাতায়াত নির্বিঘœ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নানাবিধ তৎপরতা গণমাধ্যমে দেখা গেলেও ট্রাফিক পুলিশের বেপরোয়া চাঁদাবাজি বন্ধে তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
উন্নয়নের মহাসরণীতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, সরকারের এমন দাবী কোথাও ধোপে টিকছে না। বিশেষত, দেশের প্রতিটি শহরে ও মহাসড়কে যানজট এবং জননিরাপত্তায় পুলিশের ব্যর্থতা এবং চাঁদাবাজির যেন কোন জবাবদিহিতা নেই। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে রাজধানী ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশের বেপরোয়া চাঁদাবাজির বিশদ ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন দৈনিকে মাঝে মধ্যেই এমন রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে। এসব সমস্যা এবং তার পশ্চাতের কারণগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। ট্রাফিক পুলিশের কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজির অংশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও পেয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে। তা’ না হলে যানজট কমিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার নানা প্রতিশ্রুতি, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ সত্তে¡ও যানজট কমছে না কেন? এখনো বর্ষা শুরু হয়নি, এখনি বেশীরভাগ সড়ক-মহাসড়ক খানা-খন্দে চলাচলের অনুপযোগী বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল প্রকাশিত এক রিপোর্টে বুধবার ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বিকল হয়ে পড়া ৩টি ট্রাকের কারণে ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটে হাজার হাজার যাত্রীর চরম দুর্ভোগের খবর প্রকাশিত হয়েছে। রেকার লাগিয়ে বিকল ট্রাক সরিয়ে মহাসড়কে যানচলাচল নির্বিঘœ রাখার ব্যবস্থা থাকলে ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টির কথা নয়। ক’দিন আগে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, সড়ক ও জনপথের আওতাধীন ১৯ হাজার ৩৮৭ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ১১ হাজার ৮২৬ কিলোমিটারই বেহালদশা। অর্থাৎ বর্ষা শুরুর আগেই সওজ’র ৬১ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভগ্নাবস্থায় পড়েছে। বর্ষার বৃষ্টিপাত শুরু হলে অবশিষ্ট রাস্তাগুলোর বেশীরভাগ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাস্তা মেরামতের পেছনে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও এর বেশীরভাগ অর্থই অপচয় ও লুটপাট হয়। অন্যদিকে ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ যাত্রী ও জননিরাপত্তার বদলে বেপরোয়া চাঁদাবাজির মাধ্যমে আখের গোছাচ্ছে। আর সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা উন্নয়নের ঢোল পিটাচ্ছেন। জনগণের দুর্ভোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছেনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন