সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালত আসামি বদরুল আলমকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করেছেন। যাবজ্জীবন কারাদন্ড ছাড়াও তার ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। যদি সে জরিমানার টাকা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাকে আরো দুই মাস কারাদন্ড ভোগ করতে হবে। দন্ডিত বদরুল আলম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি ছিল। সে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিল। বদরুলের বিরুদ্ধে যখন ৩২ পৃষ্ঠার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় মাননীয় বিচারক পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন তখন বদরুল আদালতের কাঠগড়ায় দন্ডায়মান ছিল। বিচারক মন্তব্য করেন যে, এই রায়টি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ঘোষিত হলো। ফলে এই রায় নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে। গত বছরের ৩ অক্টোবর বদরুল হত্যা করার উদ্দেশ্যে খাদিজার মাথায় এবং হাতে চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে। তখন খাদিজা সিলেট এমসি কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসছিল। এরপর সাংবাদিকদের কাছে প্রদত্ত প্রতিক্রিয়ায় খাদিজা বলেছে, আজ সকলের আশা পূর্ণ হয়েছে। এ জন্য সকলকে আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আশা করি, ভবিষ্যতে আমার মতো এমন ভয়াবহ অবস্থার শিকার আর যেন কেউ না হয়। সরকারপক্ষের উকিল বলেন, দ্রুত গতিতে খাদিজার মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে এবং অপরাধী শাস্তি পেয়েছে। এই রায় এ ধরনের ভয়াবহ অপরাধের বিরুদ্ধে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, খাদিজার ওপর হামলা হওয়ার পরদিন ৪ অক্টোবর মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয় ২৯ নভেম্বর। বদরুলের আইনজীবী সাজ্জাদুর রহমান স্বীকার করেন যে, বদরুল যখন খাদিজার ওপর হামলা চালায় তখন সে মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় ছিল। খাদিজার ওপর হামলা করার পর সিলেট এমসি কলেজের ছাত্ররা হামলাকারী বদরুলকে হাতেনাতে ধরে ফেলে এবং পুলিশের নিকট সোপর্দ করে। তারা খাদিজাকে সাথে সাথেই সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। সেখান থেকে পরে তাকে ঢাকার একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
বদরুলের মামলাটির চার্জ গঠন এবং রায় ঘোষণার মধ্যবর্তী সময় মাত্র ২ মাস ১০ দিন। এত সংক্ষিপ্ত সময়ে বিচারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে রায় ঘোষণা করা একটি ঐতিহাসিক ব্যাপার। দ্রুততম সময়ে বদরুলের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় ঘোষণার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতকে জনগণের পক্ষ থেকে আমরা জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ। যত দ্রুততার সাথে এই রায়টি ঘোষিত হয়েছে অনুরূপ দ্রুততার সাথে এ ধরনের অন্যান্য মামলার যদি নিষ্পত্তি করা হয় তাহলে দেশে অপরাধের সংখ্যা অনেক কমে আসবে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, এ ধরনের মামলা এবং এর চেয়েও গুরুতর মামলা দিনের পর দিন এবং ক্ষেত্রবিশেষে বছরের পর বছর অনিষ্পন্ন অবস্থায় ঝুলে আছে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে। সেটি হলো ঔঁংঃরপব ফবষধুবফ রং লঁংঃরপব ফবহরবফ. অর্থাৎ ন্যায়বিচার যদি বিলম্বিত হয় তাহলে সেই ন্যায়বিচার অস্বীকৃত হয়, অর্থাৎ সেই ন্যায়বিচার কোনো দিন পাওয়া যায় না। জনগণের চোখের সামনে ন্যায়বিচার বিলম্বিত বা অস্বীকৃত হওয়ার ভূরিভূরি নজির রয়েছে। সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের কথা মানুষ ভুলে যায়নি। ৪ বছর আগে নিজ বাসভবনে এই দম্পতি খুন হন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনি বা খুনিদের আইনের আওতায় আনা হবে। ৪৮ ঘণ্টা তো দূরের কথা, কয়েক শত ঘণ্টা পার হয়ে যায়। কিন্তু কিছুই হয় না। তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে আসেন মহিউদ্দিন খান আলমগীর। তিনিও খুনিদের গ্রেফতার করার জন্য একটি নির্দিষ্ট তারিখ বেঁধে দেন। কিন্তু কিছুই হয়নি। তারপর ৪ বছর পার হয়ে গেছে। সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের কোনো কূল-কিনারা হয়নি।
সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু চট্টগ্রামের রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয়েছেন। খুনের অভিযোগে কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুইজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি মিতু হত্যার ঘটনায় ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। বাবুল আক্তারকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। তারপর ৯ মাসেরও বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু মিতু হত্যা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। এখন বলা হচ্ছে যে, অন্যতম প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তি মিয়া মুছাকে আটক না করা পর্যন্ত হত্যারহস্য উদঘাটন করা যাচ্ছে না। মিয়া মুছা কবে আটক হবে আর কবে খুনি শনাক্ত হবে সেটা কেউ জানে না। কুমিল্লা ক্যানন্টমেন্টে তরুণী তনু খুন হলো। পত্র-পত্রিকায় এটি নিয়ে অনেক হৈ চৈ হয়েছে। কিন্তু তনু হত্যারহস্য যে অন্ধকারে ছিল সেই অন্ধকারেই রয়ে গেছে। এমনি আরো অনেক কেস রয়েছে। সরকারপন্থী ছাত্রলীগ নামক সংগঠনটির অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি এবং চাঁদাবাজির মতো অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ প্রতিনিয়ত দেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত বা সম্প্রচারিত হচ্ছে। খাদিজার মতো দুই-চারটি কেস ছাড়া কোথায়ও বিচার হচ্ছে না। ফলে বিচারহীনতার একটি সংস্কৃতি আমাদের সমাজদেহে ক্যান্সারের মতো বাসা বেঁধেছে। খাদিজা হামলা-মামলার রায়ের মতো অন্যান্য মামলারও যদি দ্রুত বিচার হতো তাহলে এসব বেপরোয়া অপরাধের রাশ টেনে ধরা সম্ভব হতো। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন মামলার রায় প্রকাশিত হয়েছে। এই রায়টিও জনগণের ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। খাদিজা হত্যাচেষ্টার মামলার রায়ও জনগণের মাঝে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এই দু’টি মামলার মতো অন্যান্য মামলার রায়ও যেন পক্ষপাতহীন হয় সেটি জনগণের প্রত্যাশা। কেউ আইনের ঊর্ধ্ব নয়। অপরাধী যেই হোক, কারো যেন কোনো অবস্থাতেই দায়মুক্তি না ঘটে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন