মোঃ ছলিম উল্লাহ খান ও মোঃ হাবিবুর রহমান, সোনাকান্দা থেকে : মোরাক্বাবা-মোশাহাদা এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অস্থির ক্বালব বা মনকে স্থির ও প্রশান্ত করা যায়। ঠা-া মাথায় অবচেতন মনের শক্তিকে অধিক পরিমাণে ব্যবহার করে নিজের ও পরের অনেক কল্যাণ করা যায়। মোরাক্বাবা-মোশাহাদা তথা ধ্যান মনকে অশুভ নফস বা প্রবৃত্তির শৃঙ্খলমুক্ত হতে সাহায্য করে এবং বান্দাকে তাক্বওয়াবান করে তোলে। আর পবিত্র কুরআনের ভাষ্যমতে, আল্লাহ পাকের নিকট মুত্তাকীরাই হচ্ছেন বিশ্বের সবচেয়ে অভিজাত বান্দা। কুমিল্লা সোনাকান্দা দারুল হুদা দরবার শরীফের পীর ও বাংলাদেশ তা’লীমে হিযবুল্লাহ’র আমীর অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওলানা মাহমুদুর রহমান দরবারের বাৎসরিক ইছালে ছাওয়াব ও দোয়ার মাহফিলের দ্বিতীয় দিনের বয়ানে একথা বলেন।
মোরাক্বাবা-মোশাহাদা ধ্যান মনকে প্রশান্ত করে, উপলব্ধি দান করে। ধ্যান এবং দোয়া একত্র হলে মানব জীবনে বহুমাত্রিক প্রাপ্তি ঘটায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পালনীয় ফরজ ইবাদত নামাজ ধ্যান ও যোগাসনের অন্যতম একটি যুগপৎ উপযোগিতা। সূরা আ’লার ১৪-১৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সবসময় প্রতিপালকের কথা স্মরণ করে, নামাজ কায়েম করে, সে ব্যক্তি সুখী ও সফল হয়।’
বস্তুত মনকে দিয়ে বড় কিছু করানোর মৌল প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া হচ্ছে মোরাক্বাবা-মোশাহাদা। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে মানুষের ৭৫ শতাংশ রোগই হচ্ছে মনোদৈহিক বা সাইকোসোমাটিক। মনের জট খুলে ফেললেই এসব রোগ-বালাই থেকে নিরাময় লাভ করা সম্ভব হয়। বুখারী শরীফের একটি হাদিসে উল্লেখ আছেÑপ্রিয় নবী (স) ইরশাদ করেন, ক্বালব বা মন ভালো থাকলে দেহ ভালো থাকে।
তিনি আরো বলেন, মোরাক্বাবা-মোশাহাদা ও ধ্যান ছাড়া আল্লাহ তায়ালার পরিচয়লাভ সম্ভব হয় না। স্বয়ং আমাদের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর মনে যখন প্রশ্ন জাগল, কে আমার ¯্রষ্টাÑতখনই তিনি ধ্যান-সাধনা তথা মোরাক্বাবায় নিমগ্ন হলেন। অবশেষে আল্লাহ পাকের পরিচয় লাভ করলেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পবিত্র কা’বা শরীফের সন্নিকটে পবিত্র জাবাল আল নূরের হেরা গুহায় ১৫ বছর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ধ্যানের পবিত্র স্থান হেরা গুহায় মোরাক্বাবার জায়গাতেই জিব্রাইল (আঃ) তার কাছে গোটা মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ পবিত্র কুরআনের প্রথম ওহী নিয়ে আসেন। হযরত মুসা (আঃ) সিনাই উপত্যাকায় ধ্যানরত থেকে তাওরাত লাভ করেন। হযরত ঈসা (আঃ) ও মরুভূমিতে মোরাক্বাবার সাধনা শেষে আসমানী কিতাব ইঞ্জিল প্রাপ্ত হন।
আমাদের ইসলাম ধর্ম হল মোরাক্বাবা-মোশাহাদা, সাধনা, আত্মশুদ্ধি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সেবার ধর্ম। এর চিরায়ত ঐতিহ্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হল মুরাকাবা, তাফাক্কুর বা ধ্যান। ধ্যানের বহুমুখী গুরুত্বের কারণে মহাপুরুষ, অলি-আওলিয়াগণ ধ্যানে নিমগ্ন হয়েছেন। হযরত মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহঃ) যিনি এক বিশেষ পদ্ধতির মোরাকাবার উদ্ভাবক। একদা তিনি গোলাপ বাগানে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। নববিবাহিত এক দম্পতি বৃদ্ধ সাধককে বাগানে দেখে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘এ বৃদ্ধ বাগানে চোখ বন্ধ করে কি করছে?’ মাওলানা রুমি বলেন, আমি চোখ বন্ধ করে যা দেখি, যদি তোমরা তা দেখতে- আমি তো মাঝে মাঝে চোখ খুলি, তোমরা তাও খুলতে না।
মোরাক্বাবা-মোশাহাদা তথা ধ্যান হল হৃদয়ের বাতি। এটি নিভে গেলে হৃদয়ে আলো থাকে না। আত্মশুদ্ধির পথে বাধাসমূহকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমত, ক্বালব বা মনের বিষ, যেমনÑরাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, ঈষা, হিংসা, অহং, আমানতহীনতা, গীবত বা পরচর্চা, মিথ্যা, হতাশা, অপবাদ, কুচিন্তা ইত্যাদি। আর অপরটি মনের বাঘ, যেমনÑনা শুকরিয়া বা নেতিবাচকতা ও অমূলক ভয়-ভীতি বা তাকওয়াহীনতা। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ক্বালব পবিত্র ও আলোকিত হয়। ইমাম গাজ্জালী (রহ) দীর্ঘ ১০ বছর নির্জনবাসের মাধ্যমে উপলব্ধি করেছিলেন, আত্মশুদ্ধি ও ধ্যান-মোশাহাদার পথেই মুক্তি। শরিয়তের সাথে সাধনাকে সংম্পৃক্ত করে তিনি ইসলামী জীবনদৃষ্টিতে পুনর্জাগরণ ঘটান। পরবর্তী প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাধক-দার্শনিক ও সর্বস্তরের মানুষ তার আত্মশুদ্ধির দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয় তার সাহসী ও উপলব্ধি জ্ঞানগর্ভ লেখনীর মাধ্যমে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন