পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক, এটা দেখতে চায়। দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতগণ এ ব্যাপারে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনাও শুরু করেছেন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সুইডেন ও নরওয়ের রাষ্ট্রদূতদ্বয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও আলোচনা করেছেন। আলোচনায় তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাকিদ দিয়েছেন এবং স্থানীয় সরকারের কয়েকটি নির্বাচন নিয়ে তাদের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নতুন ইসি কী করছে, বিশেষভাবে সেটা জানার চেষ্টা করেছেন। নির্বাচন কমিশনের সচিব জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক হয় সে বিষয়টি রাষ্ট্রদূতগণ বলেছেন। একই সঙ্গে কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। বোঝাই যায়, সৌজন্য সাক্ষাৎ হলেও সুইডেন ও নরওয়ের রাষ্ট্রদূতদ্বয় নির্বাচন কমিশনকে একটি বার্তা দিয়ে এসেছেন। পশ্চিমা দেশগুলো যে আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য দেখতে চায় সেটা তারা জানিয়ে এসেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চলাকালেই পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতগণ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট মো: আব্দুল হামিদ যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করছিলেন, তখন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতগণ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, যদিও তারা প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ পাননি। নির্বাচন কমিশন গঠনের পরও তাদের তৎপরতায় ছেদ পড়েনি। ইতোমধ্যেই মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদ্বয় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দফতরের মন্ত্রীও বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। বিএনপি ছাড়া কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গেও কূটনীতিকরা বৈঠক করেছেন। তবে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের কোনো শরিকের সঙ্গে এখনো তাদের কোনো বৈঠক হয়নি।
পশ্চিমা দেশগুলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে যে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে, তাদের রাষ্ট্রদূতগণের তৎপরতা তারই প্রমাণ বহন করে। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভালোভাবে নেয়নি। বিভিন্ন সময় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ওই নির্বাচন ছিল না অংশগ্রহণমূলক, ছিল একতরফা। প্রধান বিরোধী দলসহ অধিকাংশ বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ভোটের আগেই ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হন। ভোটের দিনেও ভোটার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। তারপরও যত প্রকার অনিয়ম ও দুর্নীতি হতে পারে, তার সবই হয়। নির্বাচন শান্তিপূর্ণও ছিল না। প্রতিদ্ব›দ্বী রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ যদি কোনো নির্বাচনে না থাকে এবং নির্বাচনটি যদি হয় প্রহসনমূলক তাহলে দেশে-বিদেশে কোথাও তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। ২০১৪ সালের নির্বাচন কার্যতই কোথাও কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সে সময় সরকারি মহল থেকে জানানো হয়, নিয়ম রক্ষার জন্যই নির্বাচনটি করা হচ্ছে। অচিরেই নতুন নির্বাচন দেয়া হবে, সেখানে সব দলের অংশ থাকবে। পরবর্তীতে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বভাবতই আশা করেছিল, সরকারি মহলের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হবে। প্রতিশ্রুতি প্রতিপালিত না হওয়ায় তারাও হতাশ। তাই আগামী নির্বাচন নিয়ে যখন তোড়জোড় শুরু হয়েছে তখন পশ্চিমা দেশগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। তাদের অভিমত ও পরামর্শ জানিয়ে দেয়ার তাকিদ থেকেই তারা এই তৎপরতায় শামিল হয়েছে। একথা কে না জানে, দেশে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সঙ্কট বিরাজ করছে, তার মূলে রয়েছে ২০১৪ সালের বিতর্কিত ও অসমর্থনীয় নির্বাচন। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচনই কেবল এ অনিশ্চয়তা ও সঙ্কট মোচনের দ্বার খুলে দিতে পারে।
জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থ, গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানমূলক রাজনীতি, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার সংরক্ষণের প্রয়োজনেই আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হওয়া দরকার। প্রশ্নবিদ্ধ কোনো নির্বাচন দেশের কেউই দেখতে চায় না, এমনকি ক্ষমতাসীন দলও। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সেটা দেখতে চায় না। পশ্চিমা কূটনীতিকদের নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা নিয়ে সরকারি মহলের অনেকে কটাক্ষ শুরু করেছেন। কেউবা একে ‘নাক গলানো’ বলে অভিহিত করেছেন। এভাবে বিষয়টি দেখা কতদূর সঙ্গত, সেটা একটা প্রশ্ন। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলতেই পারে। তারা চায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষিত হোক বা থাক। এই চাওয়াকে ভিন্নভাবে দেখা কিংবা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করা সুবিবেচনার পরিচায়ক হতে পারে না। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সঙ্কটের উৎস ও কারণ শনাক্ত করে খোলামনে সম্মিলিতভাবে তা অপনোদনের চেষ্টা করা। এ নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ বা আলোচনা হতে পারে এবং সেটা অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে। বিরোধী দলগুলোর দাবি ও অভিমত শুনতে হবে এবং যৌক্তিক, গ্রহণযোগ্য দাবি ও অভিমত মেনে নেয়ার ঔদার্য প্রদর্শন করতে হবে। যে কোনো মূল্যে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন