রবিবার মধ্যরাতে ক্রেন ছিঁড়ে গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে মালিবাগ মগবাজার ফ্লাইওভারে এক নির্মাণশ্রমিক নিহত এবং আরো কয়েকজন আহত হয়েছে। রাজধানীর উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের মধ্যে অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী উন্নয়ন প্রকল্পের নাম মগবাজার মালিবাগ ফ্লাইওভার প্রকল্প। আরো দুই বছর আগেই এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও কয়েক দফা সময় ও ব্যয়বৃদ্ধির পরও সহসা প্রকল্পটির সফল সমাপ্তির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দীর্ঘসূত্রতার একপর্যায়ে তড়িঘড়ি শেষ করতে গিয়ে কাজের মান খারাপ হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। মগবাজার মালিবাগ ফ্লাইওভারের প্রকল্প অনুমোদন এবং নকশা প্রণয়নের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়েছিল চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই। তবে সে সময় প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু না হলেও মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর প্রাক্কলন এবং বাস্তবায়নের উদ্যোগ শুরু হয় ২০১১ সালে। কাজ শেষ করে ২০১৫ সালের আগেই ফ্লাইওভারটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার কথা থাকলেও প্রকল্পের কাজ অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পর এর নকশায় বড় ধরনের ত্রæটি ধরা পড়ে। ভুল নকশার অজুহাতে সময় বাড়ানো এবং ব্যয়বৃদ্ধির সুযোগ কাজে লাগিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তবে সাম্প্রতিক সময়ের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প শেষ করতে পারেনি। বারবার সময় বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজেট বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে মূল প্রকল্প ব্যয়ের কয়েক গুণ বাড়ানো হয়েছে। মগবাজার মালিবাগ ফ্লাইওভার প্রথম দফায় প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা, দ্বিতীয় দফায় তা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৭৭২ কোটি ৭৭ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়, তৃতীয় দফা সময় ও বাজেট বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে এর ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১২২৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
দীর্ঘদিন ধরে চলমান মগবাজার ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শহরের কয়েক মিলিয়ন মানুষের জন্য নৈমিত্তিক দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ধরে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা বন্ধ রেখে চালানো হচ্ছে নির্মাণকাজ। উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে এমনিতেই রাজধানীর রাস্তাগুলো সামান্য বৃষ্টিতেই চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। রাজধানী শহরের ব্যস্ততম এলাকার যানজট নিরসনের লক্ষ্যে নির্মীয়মান এই ফ্লাইওভার প্রকল্প এখন নগরবাসীর জন্য শুধু গলার কাঁটা হয়ে ওঠেনি, একের পর এক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এটি এখন মারণফাঁদ হয়ে উঠেছে। গত রবিবার মধ্যরাতে ক্রেন ছিঁড়ে গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে কাঠমিস্ত্রির মৃত্যুর আগে বিভিন্ন সময় আরো অন্তত ৮ জনের মৃত্যু এবং ২০ জনের বেশি শ্রমিক আহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে মগবাজার মালিবাগ ফ্লাইওভার প্রকল্প গত ৬ বছর ধরে জনদুর্ভোগ, অনিশ্চয়তা, জনগণের টাকার অপচয় ও মৃত্যুর বিভীষিকার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সরকারের সংশ্লিষ্টরা যেন প্রকল্পের অনুমোদনের পর ব্যয়বৃদ্ধির পক্ষে সাফাই গাইতেই ব্যস্ত। সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন, জনদুর্ভোগ লাঘব এবং জননিরাপত্তায় যেন তাদের কোনো দায় নেই।
মগবাজার ফ্লাইওভার প্রকল্প এলাকায় ইতঃপূর্বে একাধিকবার নির্মাণশ্রমিক ও পথচারী মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও নিরাপত্তা নিশ্চিতে ন্যূনতম ব্যবস্থাও পরিলক্ষিত হয়নি। শ্রমিক ও পথচারী হতাহতের পর নিরাপত্তাব্যবস্থায় গার্ফিলতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। ইতঃপূর্বে ২০১২ সালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে একসঙ্গে ১৩ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি ও অনভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের মানুষ ফুঁসে উঠেছিল। তবে মগবাজার মালিবাগ ফ্লাইওভার নির্মাতারা সেসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রবক্তা সরকারের আমলে খোদ রাজধানী শহরে তারা বছরের পর বছর ধরে মান্ধাতা আমলের এনালগ পদ্ধতির নির্মাণকাজ চালিয়ে জনগণের নাভিশ্বাস সৃষ্টি করছে। শুধু ফ্লাইওভার প্রকল্পগুলোতেই নয়, অবকাঠামো খাতের প্রায় প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পেই এমন লেজে-গোবরে অবস্থা দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সারা বছর নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে থাকলেও বর্ষার শুরুতে রাস্তা ও বেড়িবাঁধ উন্নয়ন এবং সংস্কারে তোড়জোড় শুরু করেন। অর্থবছরের শেষ সময়ে প্রকল্পব্যয় দেখানোর প্রতিযোগিতায় নেমে কোটি কোটি টাকার লুটপাট ও ভাগ-বাটোয়ারা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। এসব নিয়ে লেখালেখি হলেও অবস্থার পরিবর্তনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে জনদুর্ভোগ ও লুটপাটে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অভিন্ন চিত্র বিদ্যমান। মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিতে শ্রমিক নিহত হওয়ার পর এক রিট শুনানি শেষে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ শ্রমিক ও পথচারীদের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিল। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি সংস্থাগুলো হাইকোর্টের আদেশ অমান্য এবং জননিরাপত্তায় গাফিলতির দায়ে অবশ্যই জবাবদিহিতা ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কঠোর নজরদারি এবং সার্বিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন এবং জনদুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন