শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদন্ড বলা হয়, তাহলে সেই মেরুদন্ডের কারিগর হচ্ছেন শিক্ষকরা। বর্তমানে একশ্রেণীর শিক্ষকের অপকর্মের ফলে গোটা শিক্ষক সমাজের ইমেজই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। সামাজিক অবস্থানের কারণে এদেশে এখনো শিক্ষকরা বিশেষ মর্যাদায় আসীন। ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিকতা ও পারিপার্শ্বিক শিক্ষাদানের কারণে শিক্ষকরা সমাজে সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসেবেই বিবেচিত অথচ গত কিছুদিনে একশ্রেণীর শিক্ষকের নানা অনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে পড়েছেন গোটা শিক্ষক সমাজ। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে তাদের মান-মর্যাদা। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন শিক্ষক। ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের কারণে একের পর এক বরখাস্ত হচ্ছেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে এসব নিয়ে খোদ শিক্ষামন্ত্রীও কথা বলেছেন। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় শিক্ষকদের জড়িত থাকার বিষয়টি এখন সর্বত্র আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি টিভি’র টকশোতেও শিক্ষাবিদরা এ নিয়ে বিতর্ক করছেন। শিক্ষকদের এ ধরনের কাজকে কলঙ্ক বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আ আ স ম আরেফিন সিদ্দিক। তিনি মনে করেন এ ধরনের কাজ যারা করছে তারা শিক্ষক নামের কলঙ্ক। তিনি আরো মনে করেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি তারা শিক্ষার্থীদের নৈতিক অবস্থান ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ ধরনের লোককে শিক্ষকতার পেশা থেকে অপসারণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রকৃত প্রস্তাবেই দেশের শিক্ষার মান নিয়েও যেসব প্রশ্ন উঠেছে তার সমাধানে দেশের শিক্ষকদের অবস্থান পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
একথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অনেকদিন থেকেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারটি নিয়ে কথা হচ্ছে। এর সাথে কে বা কারা জড়িত এনিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে খোদ শিক্ষামন্ত্রীও অনেক সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূল উৎস বিজি প্রেসকে চিহ্নিত করে এর সিন্ডিকেটও ভেঙ্গে দেন। প্রশ্নফাঁস রোধে বিজি প্রেসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা, প্রশ্ন শাখায় মেটালডিটেক্টর, পেপার ডিটেক্টর, ভল্ট ডোর, গোপন ক্যামেরা, সিসিটিভি বসানো হয়েছে এবং সেই সাথে মুদ্রিত প্রশ্ন সিলগালা করতে স্ট্রংরুমও তৈরি করা হয়েছে। কার্যত শিক্ষামন্ত্রীর চেয়ে প্রভাবশালীদের হাতে এসবের নিয়ন্ত্রণ থাকার ফলেই মন্ত্রণালয় অসহায় বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকদের নেতৃত্বাধীন একটি চক্র জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রে নেয়ার পথে বা প্রশ্ন ভাগ করার সময়ে ছবি তুলে তা সংগ্রহ করেন। পরীক্ষা শুরুর দেড় দুই ঘণ্টা আগে ফাঁস হচ্ছে প্রশ্নপত্র। সেই প্রশ্নের সমাধানও হচ্ছে ১০ মিনিটের মধ্যেই। আর অতি অল্প সময়ের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। প্রশ্ন ফাঁসের মতোই গত কিছুদিনে সারাদেশে যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছেন শিক্ষক নামের কিছু দুশ্চরিত্র লোক। নজিরবিহীনভাবে লম্পটদের শাস্তির দাবিতে মিছিল হয়েছে। অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। গত অক্টোবর মাসের ২১ দিনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২৯টি যৌন অভিযোগে জমা পড়েছে। প্রকাশিত রিপোর্টগুলোতে দেখা যাচ্ছে দেশের নামী-দামী শিক্ষায়তনই এর সাথে অধিক মাত্রায় জড়িত। অবস্থা দেখে মনে হতে পারে যেন অনেকটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সংগত বিবেচনা থেকেই প্রশ্ন উঠতে পারে এ অবস্থার কারণ কি? অবশ্যই এর সাথে শিক্ষক নিয়োগের সততার বিষয়টি জড়িত। কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে বাসা-বাড়ীতে কাম-কাজ করাই কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হবার যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সার্টিফিকেটের যোগ্যতা থাক বা না থাক আত্মীয়তা, রাজনৈতিক সম্পর্ককেই নিয়োগপ্রাপ্তির বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ ঘটনা কেবলমাত্র একটি ক্ষেত্রে হয়েছে তা যেমন বলা যাবে না, তেমনি এর প্রতিবিধানে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তারও কোন উদাহরণ নেই। সোজা ভাষায় বললে এই দাঁড়ায় যে শিক্ষা খাতে প্রচন্ড দলীয়করণের বিষফল হিসেবেই শিক্ষাখাতের এ নৈরাজ্য। সমাজ, রাষ্ট্রে মূল্যবোধের চর্চার প্রসঙ্গও এখানে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেকেই যখন ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা শুনলেই আঁতকে উঠেন এখন বিশ্লেষণের সময় এসেছে তারা প্রকৃতপক্ষে সমাজকে কোথায় নিয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন।
যেভাবেই ব্যাখ্যা করা যাক না কেন একশ্রেণীর শিক্ষকের দুর্বৃৃত্তায়ন মূল শিক্ষার সুফল নিয়ে মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একটি সমাজে শিক্ষকরাই যদি আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকেন, তাহলে সে সমাজের চিত্র বুঝতে অন্যকোন ব্যারোমিটারের প্রয়োজন হয় না। সমাজের মেরুদন্ডের কারিগররাই যদি অনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকেন, তাহলে তারা যাদের শিক্ষা দিয়েছেন বা দেন তারা সমাজের জন্য কতটা প্রয়োজনীয় হয়ে গড়ে উঠছে বা উঠতে পারছে তা বোধকরি লিখে বুঝাবার কোন প্রয়োজন নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজে জবাবদিহিতা না থাকার কারণে সমাজে শিক্ষায় এধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পেরেছে। খোদ শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ব্যর্থ হবার অর্থ হচ্ছে নামে শিক্ষক হলেও প্রকৃতপক্ষে দুর্বৃত্তরা অনেক প্রভাবশালী। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হলে তা কোন কাজে লাগে না। অনেকদিন থেকেই শিক্ষার মান নিয়ে কথা উঠেছে। মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, শিক্ষকরাই যদি মানসম্মত না হয় তাহলে মানসম্মত শিক্ষা কোথায় পাওয়া যাবে। গত কয়েকবছর ধরে প্রাথমিক থেকে শুরু করে দেশের সবক’টি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব পরীক্ষায় যারা অংশ নিয়েছে তাদের যোগ্যতা নিয়েও সংগত প্রশ্ন রয়েছে। পাশাপাশি ভাল রকম প্রস্তুতি নেয়া মেধাবী ও পরিশ্রমী শিক্ষার্থীদের উপর এ দুর্নীতি এক চরম আঘাত। অবস্থা হয়ত এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে ভাল শিক্ষক আদৌ পাওয়া যাবে কিনা সে প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী খারাপ অর্থ ভাল অর্থকে বাজার থেকে তাড়িয়ে দেয়। এখন যা অবস্থা হয়েছে তাতে খারাপরাই ভালদের সমাজ চাকা থেকে হটিয়ে দিয়েছে। এই অবস্থার অবসানের মূলে কাজ করতে হবে। অবশ্যই ভাববার রয়েছে কেন এমনটা ঘটছে। শিক্ষাখাতে এবং শিক্ষকদের এখন বেতন-ভাতার পরিবর্তন হয়েছে। সে কারণে শিক্ষারমান এবং দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা গঠনের প্রয়োজনেই দলমত নির্বিশেষে শিক্ষানুরাগী দক্ষ যোগ্যদের নিয়োগ দেয়া অত্যন্ত অপরিহার্য। প্রশ্নফাঁস বা অন্য কেলেঙ্কারিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোন কারণ নেই। সামগ্রিকতার আলোকেই দেখতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখবেন এটাই জনগণ প্রত্যাশা করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন