কূটনৈতিক সংবাদদাতা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়সূচি জানানো হয়েছে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক যৌথ ঘোষণায়। সূচি অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর তিনদিনের এই সফর শুরু হবে ৭ এপ্রিল। পরদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন শেখ হাসিনা। সফরের সময় দু’পক্ষের মধ্যে নির্দিষ্ট কোন্ বিষয়ে আলোচনা হবে সেটা যৌথ ঘোষণায় বলা হয়নি। তার এই সফরে দু’ডজন চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও বিভিন্ন দলিল সই হতে পারে। সফরকালে দু’দেশের ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে দিল্লি এবং ঢাকার মিডিয়ায় সম্প্রতি বলা হয়েছে আলোচনায় দু’দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে একটি চুক্তির বিষয় থাকতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তির ওপর পুনরায় জোর দেয়া হবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। সেই সাথে গঙ্গা ব্যারেজসহ দু’দেশের অমীমাংসিত সব বিষয় এবং সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়গুলোও থাকবে বলে জানা গেছে। বর্তমানে ঢাকা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিকে একমাত্র বিষয় বলে মনে করছে না। ভারত থেকে বয়ে আসা সব নদীর পানির ন্যায্যভাগই বাংলাদেশের কাম্য। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ভারতের সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে দিল্লির অতি আগ্রহ ঢাকার সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি। এর জন্য বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিতেও প্রস্তুত ভারত। তবে বাংলাদেশ প্রাধান্য দিচ্ছে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি ও গঙ্গা ব্যারেজের ওপর। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অবশ্য ভারতের হাইকমিশনার শ্রীংলা প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন। কিন্তু ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস-এর খবরে বলা হয়েছে, ভারত এমন একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি চাইছে যার আওতায় প্রশিক্ষণ, সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি এবং দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। তারা আরো জানায়, প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে, তবে এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
তবে ঢাকার পক্ষ থেকে একটি সমঝোতা স্মারক নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে জানানো হয়েছে দিল্লিকে। অনেক দেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার বিষয় থাকলেও বাংলাদেশ পৃথিবীর কোনো দেশের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেনি। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। সাবেক কূটনীতিক হুমায়ন কবীরের মতে, বাংলাদেশের প্রাধান্যের তালিকায় এই মুহূর্তে অন্যান্য আরও অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো নিয়ে ভারতের সাথে কথা বলার সুযোগ আছে। আমার মনে হয় সে জায়গায় মনোযোগী হওয়া উচিত।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত কয়েকটি চুক্তি এবং তাদের কাছ থেকে সাবমেরিন কেনার পর ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বিগ্ন ভারত। সেই উদ্বেগ দূর করতেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে প্রতিরক্ষা চুক্তির তোড়জোড় করছে ভারত। হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, প্রতিরক্ষা খাতে চীন-বাংলাদেশ নৈকট্য বাড়ছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যাপারে ভারত উঠেপড়ে লেগেছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক ত্রিদিব চক্রবর্তীর মতে, বিকাশমুখী দেশ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়ন বা সামরিক উপকরণ সংগ্রহে চীনের সহযোগিতা চাইতেই পারে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ভারতের বিবেচ্য সেটাকে ‘ব্যালেন্স’ করতে পারা।
তবে অধ্যাপক চক্রবর্তীর মতে, ঢাকা যদি বেজিংকে দিল্লির বিরুদ্ধে তুরুপের তাস করতে চায়, তাহলে সেটা ভুল কাজ হবে। লাভের বদলে এতে লোকসান হবে বেশি, অন্ততপক্ষে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ঐতিহাসিক ভিত্তিভূমির নিরিখে।
প্রসঙ্গত, দুই বছর আগে নরেন্দ্র মোদী ঢাকা ঘুরে যাওয়ার পর এবার দেশটিতে সফরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। গতকালের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, আসন্ন এই সফরের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের উষ্ণ এবং সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কের আরও অগ্রগতি হবে, বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ় হবে এবং দুই নেতার মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
প্রধানমন্ত্রীর এই রাষ্ট্রীয় সফর হচ্ছে সাত বছর পর। সবশেষ ২০১০ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গিয়েছিলেন তিনি। আর তারপর ২০১৫ সালের জুনে বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে তিন দফা পেছানো হয় শেখ হাসিনার সফরসূচি। এরপর ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবরের ঢাকা সফরের সময় ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ্বে ওই সফরের ইঙ্গিত দেয়া হলেও তা হয়নি। এর মধ্যে গত অক্টোবরে ভারতের গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তা দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল না। গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সফরের সময় চূড়ান্ত করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর। তবে তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনার সঙ্গে জয়শঙ্করের বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেসসচিব এম নজরুল ইসলাম এপ্রিলের প্রথমার্ধ্বে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
দুই দেশই এই সফরকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। এরই মধ্যে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি ভবনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে থাকতে নিমন্ত্রণও জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভারতের হাইকামশনার হর্ষবর্ধন শ্রীংলা গত সোমবার পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গে দিল্লি সফরের প্রস্তুতিমূলক আলোচনা করার সময় আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র হস্তান্তর করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সামরিক সমঝোতায় দুই দেশ সম্মতি দিলে প্রশিক্ষণের স্বার্থে সামরিক বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষকদের সফর বিনিময়ের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ প্রশিক্ষণ পরিচালিত হবে। এছাড়া সামরিক ও শিক্ষামূলক কোর্স বা কার্যক্রমে দুই দেশের বাহিনীর সদস্যরা অংশ নেবেন।
সমঝোতা স্মারকের খসড়ায় আরো আছে, দুই দেশের যুদ্ধজাহাজ এবং উড়োজাহাজ-এর সফর বিনিময়, আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক রেখায় সমন্বিত টহলসহ যৌথ ও সমন্বিত অনুশীলন, মহাকাশ প্রযুক্তি সহযোগিতা ও সামুদ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নের মতো বিভিন্ন দিক। খসড়ায় প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় দ্বিপাক্ষিক তথ্য আদান-প্রদানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে তথ্য নিরাপত্তার শর্তগুলো সমঝোতা স্মারকের নির্ধারিত মেয়াদ শেষেও কার্যকর থাকবে। দুই পক্ষের সই করার দিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য কার্যকর হবে এই সমঝোতা। আর মেয়াদ শেষের অন্তত তিনমাস আগে কোনো একটি পক্ষ লিখিত আপত্তি না জানালে আরো পাঁচ বছরের জন্য এই সমঝোতা কার্যকর হবে। বাংলাদেশের নৌ ও উপকূলরক্ষী বাহিনীর জন্য জাহাজ, সামরিক উপকরণ এবং ট্রেনিং দিয়ে সাহায্য করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে ভারতের তরফ থেকে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী ২০১৫ সালে ঢাকা সফরে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন, তার মধ্যে স্থলসীমা চুক্তির বেশিরভাগ ও ছিটমহল বিনিময় ছাড়া বাংলাদেশের কাছে যেটা এই মুহূর্তে সব থেকে জরুরি, সেই তিস্তা চুক্তি নিয়ে কিছুই হয়নি। অন্যদিকে সন্ত্রাস থেকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে দু’দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য। সে কারণে শেখ হাসিনার ভারত সফরের একটা অন্য তাৎপর্যও থেকে যাচ্ছে। সন্ত্রাস প্রশ্নে দিল্লি যেভাবে ঢাকাকে পাশে পেয়েছে, তা প্রশ্নাতীত। নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এ সমর্থন দিয়েছিল ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন