ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল বিজয় একাত্তরের নিয়ন্ত্রণ নিতে গত সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হলে তান্ডব চালিয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে হলটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে আবাসিক শিক্ষার্থীদের হলে তোলা, সিট বণ্টন এবং শাস্তি দেয়ার মতো কাজগুলো প্রশাসনের মাধ্যমে পরিচালিত হলেও প্রশাসনকে পাশ কাটিয়ে ছাত্রলীগের নেতারা নিজেরাই হলের বিভিন্ন কক্ষে ছাত্রদের তুলে দেয়। বের করে দেয়ার হুমকি দেয় সাধারণ ছাত্রদের। আবাসিক ছাত্ররা বাধা দিতে গেলে তাদের ধাওয়া করা হয়। প্রাধ্যক্ষের উপস্থিতিতে তার কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। মারধরের শিকার হন একজন সাংবাদিকও। ঘটনার বিবরণে বলা হয়েছে, মূল কক্ষগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে না পেরে গত বছর হলের খেলার কক্ষটিকে গণরুম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে ছাত্রলীগ। সেখানে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ছাত্র সংগঠগুলো তাদের কর্মী বা অনুসারিদের তোলে। তাদের দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচী করায়। এসব কক্ষে সাধারণত ধারন ক্ষমতার চেয়ে চার পাঁচগুণ বেশি শিক্ষার্থী থাকে। বিজয় একাত্তর হলের গণরুমে প্রায় ৩০ শিক্ষার্থী রয়েছে। তারা গণরুম ছেড়ে মূল কক্ষগুলোতে উঠতে চাইলে গত সোমবার রাত ১২টার দিকে হলের কক্ষগুলোতে দু’একজন করে তুলে দেয় ছাত্রলীগ। কক্ষের প্রকৃত ছাত্ররা বাধা দিলে তাদের হল থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এপ্রসঙ্গে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একটি দৈনিককে জানিয়েছেন, আসন না পাওয়া শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন কক্ষে উঠেছে। হলের প্রাধ্যক্ষ শফিউল আলম জানিয়েছেন, হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক ড. মোহাম্মদ আসিফ হোসেন খানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ছাত্রলীগ যাদের বিভিন্ন কক্ষে তুলে দিয়েছে তারা কেউ এসব কক্ষে থাকতে পারবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর দখল নিয়ে এর আগেও বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। হল দখল নিয়ে রক্তাক্ত ঘটনাও অতীতে ঘটেছে। শিক্ষার্থীর নামে কর্মী পালনে বাধ্যকরণের জের হিসেবে ইতোপূর্বে একজন ছাত্রের অকাল মৃত্যুর খবরও প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের হলগুলো ছাত্রীগের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। কাগজ কলমে যাই থাক প্রশাসনকে পাশ কাটিয়ে ছাত্রলীগ নেতারা নিজেরাই বিভিন্ন কক্ষে ছাত্রদের তুলে দেয়। আলোচ্য হল ছাড়া ১৭টি আবাসিক হলে ১২৮টি গণরুম রয়েছে। ছাত্রলীগের সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত জানুয়ারিতে প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়া মোট ছাত্রের প্রায় ২৫ শতাংশকে হলে উঠিয়েছে ছাত্রলীগ। সেখানে শিক্ষার্থীরা গাদাগাদি করে বিভিন্ন কক্ষ, বারান্দা ও ছাদে থাকে। শিক্ষার্থীরদের ভালো কক্ষে সীট দেয়ার আশ্বাস দিয়ে রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সর্বশেষ গত ২ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রলীগের নিয়মিত কর্মসূচীতে অংশ না নেয়ায় কবি জসিম উদদ্ীন হলের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়। ক’দিন আগে তার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। এদিকে সুর্যসেন হলের সভাপতি হল কমিটি গঠনের পরপরই নয়টি কক্ষ থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বের করে দিয়ে নিজ অনুসারিদের উঠিয়েছে। গত বছরের শেষদিকে ১৮টি হলে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষিত হবার পর গত তিনমাসে বিভিন্ন হল থেকে অন্তত ৩০ জনকে বের করে দিয়েছে ছাত্রলীগ। অন্যদিকে হলগুলোর আধিপত্য ধরে রাখতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। যেসব শিক্ষার্থীর ঢাকায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার মত বাস্তবতা নেই তাদের সুবিধার্থেই হলের আবাসিক সুবিধা দেয়া হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের অসহায়ত্বকে কেন্দ্র করে সেখানে মূলত টর্চার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেখানে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ছাত্রদের শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষায়তনে চলছে নানা অনিয়ম। বলা যায়, একধরনের জবরদস্তিমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এমন কি বিভিন্ন টেন্ডারবাজীতেও এই সব বিশেষণে তারা তাদের তথাকথিত সমর্থদের ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রশাসন রয়েছে। এর কর্মকর্তারা কিভাবে এসব সহ্য করছেন তা বোধগম্য নয়। এই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, দেশের প্রায় সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র মোটামোটি এক রকম। সর্বত্রই ছাত্রলীগের প্রতাপ ও প্রতিপত্তি। আবার নিজেদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে মারামারি-খুনোখুনির ঘটনাও প্রায় নিত্যদিনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেখা যায়, যখনই কোন ঘটনা ঘটে তখন সংশ্লিষ্টরা কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। তারপর আর এর কোন বাস্তবায়নে লক্ষ্য করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরকারি ছাত্রসংগঠনের জিম্মি হয়ে পড়েছে। এটা শিক্ষা পরিবেশের জন্য বড় ধরনের অন্তরায়। শিক্ষায়তনকে শিক্ষার উপযুক্ত কেন্দ্র করে গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন