প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিচার বিভাগকে জিম্মি করে রাখার অভিযোগ তুলেছেন। বহুল আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ মাসদার হোসেন বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলার রায়ে ১৯৯৯ সালের ২রা ডিসেম্বর সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগ ও চাকুরীর শৃঙ্খলা বিধি সংক্রান্ত ১২ দফা নির্দেশনা প্রদান করে। বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব কমিয়ে এনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য এসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এরপর বছরের পর বছর ধরে চলা আইনগত প্রক্রিয়ায় অব্যাহত সময়ক্ষেপণ এবং সরকার ও বিচারবিভাগের রশি টানাটানির এক পর্যায়ে গত বছর আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক বিচারকদের চাকুরীর বিধিমালার আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো খসড়া আপীল বিভাগের সংশোধনীর পর তা’ গেজেট আকারে প্রকাশের সময় বেঁধে দেয় আদালত। এই গেজেট প্রকাশের সময় রাষ্ট্রপক্ষের বার বার সময় চাওয়া এবং সময় ক্ষেপণের প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতি এটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বিচার বিভাগকে জিম্মি করে রাখার অভিযোগ তোলেন। ১৫ জানুয়ারীর মধ্যে অধস্তন আদালতের বিচারকদের আচরণ বিধি ও অপসারণ সংক্রান্ত বিধান গেজেট আকারে প্রকাশের সময় দেয়া হলেও আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক পোস্টে বলা হয়, “বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের প্রস্তাবিত খসড়া বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই মর্মে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সানুগ্রহ সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন।” আইন মন্ত্রণালয় ও সরকারের এ অবস্থানের প্রেক্ষাপটে আপীল বিভাগ থেকে বলা হয়েছিল ‘রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হয়েছে’। আদালত পুনরায় ১২ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিলেও এটর্নি জেনারেল ধারাবাহিকভাবে সময় প্রার্থনা করেই চলেছেন।
গেজেট প্রকাশ না হলেও সর্বোচ্চ আদালতের রায় আইনে পরিণত হতে কোন বাধা নেই বলে মত দিয়েছেন আইনবিদরা। এর ভিত্তি হচ্ছে সংবিধানে গেজেটকেই আইন তৈরীর একমাত্র অবলম্বন করা হয়নি। আদালত নিজেই তার আদেশকে আইন করার এখতিয়ার রাখেন। তবে এ বিষয়টি কোন সাধারণ বিচারিক আদেশ নয়, এর সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অন্যদিকে আপীল বিভাগের সর্বসাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, নির্বাহী বিভাগের সাথে বিচার বিভাগের কোন দ্ব›দ্ব নেই। প্রশাসনের সঙ্গে বিচার বিভাগ মুখোমুখি অবস্থানে যেতে চায়না। আদালত চান বিচারকদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত চাকুরী বিধিমালার গেজেট জারি করা হোক। আদালতের এই মনোভাবের সাথে এটর্নি জেনারেল একাত্মতা প্রকাশ করলেও গেজেট প্রকাশ না করে রাষ্ট্রপতির আদেশ আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে প্রকাশ এবং সরকারের পক্ষ থেকে অযৌক্তিকভাবে বার বার সময় চাওয়ার কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সরকার ও বিচার বিভাগের ভিন্ন অবস্থানের বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ছে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা ও চাকুরী বিধি সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় কিছু কিছু বিচারক শৃঙ্খলার বাইরে চলে যাচ্ছেন বলেও মত দিয়েছে আপীল বিভাগ। এহেন বাস্তবতায় বিচার বিভাগকে দ্বৈত নিয়ন্ত্রণের কুফল থেকে রক্ষা এবং সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থেই বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। লাখো প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত সংবিধান রক্ষায় সুপ্রীম কোর্টের দায়-দায়িত্ব বিষয়ে মাসদার হোসেন মামলায় একাধিক সাবেক প্রধান বিচারপতি গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন, একই প্রকার মামলায় ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের আদেশ ও সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গও এসেছে। আমাদের বর্তমান প্রধান বিচারপতির কণ্ঠেও সেই একই সুর শোনা যাচ্ছে।
ব্যক্তি ও সামষ্টিক আইনগত অধিকার রক্ষায় বিচারবিভাগের স্বাধীনতা যে কোন রাষ্ট্রের প্রধান মানদন্ড। আইনের শাসনের মানদন্ড এবং ন্যাচারাল জাস্টিসের সাধারণ অনুজ্ঞাকে ক্ষুণœ করে এমন যে কোন আইন বা রাষ্ট্রপতির আদেশও সুপ্রীম কোর্ট বাতিল করে দিতে পারে। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেও ১৯৭৫ সালে সংবিধানের ১১৫ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অধস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ ও অপসারণ সংক্রান্ত বিধানাবলীর ক্ষেত্রে ‘সুপ্রীম কোর্টে’র স্থলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার মধ্য দিয়ে এই সংকটের সৃষ্টি করা হয়। ১৯৭৫ সালের বাকশাল আইনের ১৮ নম্বর ধারায় সুপ্রীম কোর্টের কর্তৃত্ব খর্ব করে রাষ্ট্রপতিকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদানকেই এই সংকটের উৎস বলে মনে করা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও এখতিয়ার সংকুচিত হয়। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কারো সাথে রাষ্ট্রপতির আলোচনা বা সুপারিশের সাংবিধানিক বিধান না থাকলেও সব বিষয়েই প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে থাকে, এই ধারণা এখন প্রতিষ্ঠিত। মাসদার হোসেন মামলায়ও বিভিন্ন সময়ে সাবেক প্রধান বিচারপতিগণ বিচার বিভাগকে প্রধানমন্ত্রী তথা নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত রাখার কথা বলেছেন। একদিকে বিচার বিভাগ পূর্ণ স্বাধীন বলে দাবী করছে সরকার, অন্যদিকে নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচারিক কার্যক্রমে সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ ও বিবেচনার প্রতিফলন বেশ স্পষ্ট। দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা ভর করেছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে দেশের সব প্রতিষ্ঠান জিম্মি হয়ে পড়েছে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন