শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য

| প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রাজধানী ঢাকা শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষের আশিভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্রশ্রেণীভুক্ত। এদের প্রায় সবাইকে প্রতিদিনই কোন না কোন গণপরিবহন, সিএনজি, রিকশা ও ভাড়া গাড়ির উপর নির্ভর করতে হয়। শুধু ঢাকায়ই নয়, দেশের কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন গণপরিবহনের উপর নির্ভরশীল। গণপরিবহনের উপর সাধারণ মানুষের এই নির্ভরশীলতাকে পুঁজি করে পরিবহন মালিকরা যথেচ্ছ ভাড়া আদায় করছে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজির বিনিময়ে প্রভাবশালী মহল ও পুলিশ ভাড়া নৈরাজ্যকে জায়েজ করে দিচ্ছে। নানা অজুহাতে নানাভাবে সাধারণ দরিদ্র মানুষের পকেট কাটছে গণপরিবহন সিন্ডিকেট। সারাবিশ্বে যখন জ্বালানি তেলের মূল্য কমে, আমাদের দেশে তখনো তেল-গ্যাসের মূল্য বাড়ে। একেকবার জ্বালানি মূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি পায়। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে যৌক্তিক হারে ভাড়া বৃদ্ধির কথা বলা হলেও পরিবহন মালিক সমিতি কয়েকগুণ বাড়িয়ে ভাড়া আদায় করে থাকে। এ কারণে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি পেলেও সরকারের রাজস্ব বাড়ে, পরিবহন মালিকদের লাভের অঙ্ক বাড়ে। সব বৃদ্ধির দায় পড়ে দরিদ্র মানুষের উপর। শহরের লোকাল বাস-মিনিবাস, সিএনজি অটোরিক্সা, ক্যাব, দূরপাল্লার কোচ সার্ভিস ইত্যাদি গণপরিবহনের কোথাও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার যেন কোন তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ নেই। পরিবহন মালিক ও সমিতিগুলো যথেচ্ছভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।
যতই দিন যাচ্ছে গণপরিবহনে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা ততই প্রকট হয়ে উঠছে। সকাল বেলা ঘর থেকে বেরিয়ে অফিসমুখী বাস ধরতে গিয়ে প্রতিদিনই অনাকাক্সিক্ষত বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে কর্মজীবী মানুষ। লোকাল বাসগুলো যখন তখন সিটিং, গেইটলক সার্ভিসের নামে ভাড়া দু’তিনগুণ বাড়িয়ে নিচ্ছে। শহরের লোকাল বাসগুলো স্বল্প দূরত্বের যাত্রী পরিবহনে বাধ্য থাকলেও বেশী ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে তারা ডাইরেক্ট সার্ভিস বলে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের ভোগান্তির মুখে ঠেলে দিলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। পুলিশ ও সরকারের প্রভাবশালী মহলকে চাঁদাবাজির টাকার একটি অংশের ভাগ দিয়ে তাদেরকে নিস্ক্রিয় করে রাখা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে পরিবহনের ফিটনেস, রুটপারমিট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করা হলেও যাত্রী সাধারণের নৈমিত্তিক ভোগান্তি এবং নানা অজুহাতে ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এসব মোবাইলকোর্ট বা ট্রাফিক কর্তৃপক্ষের কখনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। পরিবহন মালিক ও মালিক-শ্রমিক সমিতিগুলোর কাছে দেশের মানুষের জিম্মিদশা, ভোগান্তি ও অসহায়ত্বের মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্টদের ডাবল স্টান্ডার্ড ভূমিকা দেখা গেছে সাম্প্রতিক পরিবহন ধর্মঘটের সময়। চালকের অদক্ষতা ও গাফিলতির কারণে সড়কে প্রতিমাসে শত শত মানুষের মৃত্যু হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। দেশবাসীকে এমনই বার্তা দিয়েছে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় থাকা পরিবহন মালিকর-শ্রমিকরা। পাশাপাশি টেক্সি ক্যাব সার্ভিস এবং সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশা আইন ও নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করার প্রয়োজন বোধ করে না। এসব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ কোথাও কোন প্রতিকার পায় না।  
বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় ৬-৭ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য ও নিকৃষ্ট তালিকায় স্থান পাচ্ছে। সম্প্রতি ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মার্সারের পরিচালিত জরিপ রিপোর্টে বিশ্বের ২৩০টি শহরের মধ্যে ঢাকা এবার গত বছরের চেয়ে ১০ ধাপ পিছিয়ে ২১৪ নম্বরে স্থান পেয়েছে। জননিরাপত্তা, জীবনযাপনের মানের বিভিন্ন মানদÐকে সামনে রেখে পরিচালিত এই রিপোর্টে গণপরিবহন, স্বচ্ছন্দ ও নির্বিঘœ চলাচল এবং রোড সেইফটি অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। রাস্তায় খানাখন্দ, গণপরিবহনে জনদুর্ভোগ, অস্বাভাবিক যানজট, যথেচ্ছ ভাড়া আদায় এবং নিয়ম-শৃঙ্খলার কোন তোয়াক্কা না করার কারণে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা একদিকে নগরবাসীর বিড়ম্বনার একটি অনিবার্য বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বের কাছে আমাদের প্রিয় রাজধানী শহরটিকে অন্যতম নিকৃষ্ট শহর হিসেবে তুলে ধরে জাতির ভাবমর্যাদা, বিনিয়োগ-পর্যটনসহ অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে দূরূহ করে তুলেছে। যত্রতত্র যথেচ্ছ ভাড়াবৃদ্ধি, রুট পরিবর্তন, যাত্রীদের সাথে অসৌজন্য আচরণ, দুর্ব্যবহার চালকের অদক্ষতার কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর এমন বল্গাহীন মিছিল বিশ্বের আর কোথাও নেই। সরকারের সংশ্লিষ্টরা যতই উন্নয়নের নামে রাজনৈতিক গলাবাজি করছেন, সড়ক ও ফ্লাইওভারে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও জনদুর্ভোগ কমানোর বাস্তব উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, নৈরাজ্য বন্ধ করে জনবান্ধব ও যাত্রীবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই। সড়ক-মহাসড়ক, রেলপথ, লোকাল বাস, সিএনজি ও টেক্সি ক্যাব সার্ভিসকে আধুনিক জনবান্ধব এবং সুলভ করে তুলতে সরকারকে সব ধরনের উদ্যোগ ও মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন