রোহিঙ্গা সংকট দূর করতে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। গত বছরের শুরুতে জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে ও কোফি আনানের নেতৃত্বে এই কমিশন গঠিত হলেও রাখাইনের উগ্রপন্থী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। বিরোধিতা সত্তে¡ও কমিশন রাখাইনে, মিয়ানমার সরকারের সংশ্লিষ্টদের সাথে এবং বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ঘুরে প্রকৃত অবস্থা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সচেষ্ট রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কোফি আনান কমিশন বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার আহ্বান জানাল। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের শত শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বহীন ও অবাঞ্ছিত করে তোলা হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের এই বঞ্চনার শুরু হয়েছিল বৃটিশ শাসনের শেষদিকে। সে সময় একটি জাতিগত জরিপে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নাম থাকলেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেয়া হয়। পরবর্তীকালে বার্মার স্বাধীনতার পর সামরিক জান্তা সরকার রাখাইনের বৌদ্ধ উগ্রপন্থী এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরোধকে কাজে লাগিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের পক্ষাবলম্বন করে বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাদের উপর নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বারবার রোহিঙ্গারা নির্বিচার গণহত্যা এবং উচ্ছেদের শিকার হয়েছে। নিকটতম প্রতিবেশী এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক থাকায় প্রতিবার দমন-পীড়নের শিকার হওয়ার পর হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদী পেরিয়ে কক্সবাজারে প্রবেশ করে এখানে শরণার্থী জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।
চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বহন করলেও এ বিষয়ে আঞ্চলিক শক্তি ও বিশ্বসম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততা ছিল বিস্ময়কর। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অন্যায় অভিযানের সময় দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের পর ২০১২ সালে এবং গত বছর পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন ক্রমেই বেড়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতা এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততার কারণেই এমন প্রলম্বিত ও উপর্যুপরি দমনাভিযান অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে। মিয়ানমারে প্রথমবারের মত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সঙ্গত কারণেই সকলের প্রত্যাশা ছিল গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সুচি রোহিঙ্গা সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তার শাসনামলেই রোহিঙ্গারা ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা ও দমনাভিযানের শিকার হয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ধারাবাহিক আহ্বান এবং চাপ উপেক্ষা করেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা সংকট জিইয়ে রাখার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। তবে বিশ্বের অন্যান্য জাতিগত সংকট নিরসনে পশ্চিমা বিশ্ব তথা বিশ্বসম্প্রদায় যতটা ত্বরিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পাশাপাশি কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে রোহিঙ্গা মুসলমানরা নির্মম এথনিক ক্লিনজিংয়ের শিকার হয়েও সে ধরনের আনুকূল্য থেকে সব সময় বঞ্চিত হয়েছে।
পশ্চিমাদের রিজাইম চেঞ্জ এবং আইএস বিরোধীযুদ্ধের কারণে সিরিয়াসহ কয়েকটি দেশের মানবিক বিপর্যয় ও শরণার্থী সংকটের প্রতি সব পরাশক্তির সম্পৃক্ততা থাকলেও র্ভিন্ন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে রোহিঙ্গা গণহত্যা বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে মানবিক বিপর্যয় হিসেবে বিবেচিত হলেও এ বিষয়ে চাপ সৃষ্টির কোন চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। কোফি আনান কমিশনের সুস্পষ্ট আহ্বানে সাড়া দিয়ে মিয়ানমার সরকার সংকট নিরসনে এগিয়ে না আসলে কালক্ষেপণ না করে বিকল্প কার্যকর উদ্যোগের কথা ভাবতে হবে। সাম্প্রতিক দমনাভিযানের সময় শুধুমাত্র বাংলাদেশেই দেড়লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক মহলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কোন শর্ত ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে এসব রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার পাশাপাশি রাখাইন থেকে সেনা ছাউনিগুলো গুটিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার সরকারকে তার সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আনান কমিশনের অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্টের পাশাপাশি জেনেভা থেকে টেলিফোনে এমনটিই জানিয়েছেন কোফি আনান। মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে বিনিয়োগগত যেসব অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা কাজে লাগাতে এবং বাংলাদেশের মত প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে পারস্পরিক ও আঞ্চলিক স্বার্থে রোহিঙ্গা সংকটের রাজনৈতিক সমাধান জরুরি। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি মিয়ানমারের অগ্রযাত্রা এবং বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে। এ ক্ষেত্রে চীনসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সতর্ক দৃষ্টি উপেক্ষা করা মিয়ানমারের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। অতএব সংকট নিরসনে আমরা তাদের ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখতে চাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন