মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৩৬টি বৃহদাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফাস্টট্র্যাকে বাস্তবায়নের জন্য ১০টি প্রকল্প নেয়া হয়। দেখা যাচ্ছে, গত ৮ বছরে এসব প্রকল্পের সম্মিলিত কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২০ ভাগ। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে এই ধীর গতির কারণে আগামী ৮ বছরে বাকি ৮০ ভাগ কাজ করা অনেকটা অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর ফলে আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য সহায়ক এসব প্রকল্প সময় মতো বাস্তবায়ন না হলে, সে স্বপ্ন ধূসর হয়ে পড়বে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তার যোগানদাতা তিন দেশ চীন, জাপান ও ভারত। ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক মাসে হঠাৎ করে দেশ তিনটি প্রতিশ্রুত অর্থছাড় কমিয়ে দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে দেশগুলোর প্রকল্প সহায়তায় অর্থছাড় কমেছে সাড়ে ১৯ শতাংশ। অর্থছাড় কেন কমলো, তার কোনো সঠিক জবাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে গতিতে কাজ চলছে তাতে নির্দিষ্ট সময়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে। যে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে সরকার সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছে, সেই সেতুও যথাসময়ে শেষ হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এর কাজ হয়েছে মাত্র ৩৯ শতাংশ। ফলে আগামী বছর সেতুটির বাস্তবায়নের যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা পূরণ করা অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়বে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ধীর গতির কারণে ব্যয়ও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পগুলোর ব্যয় নির্ধারিত ব্যয়ের মধ্যে না থাকার আশঙ্কাই বেশি।
আমাদের দেশে ছোট, মাঝারি বা বড় যে প্রকল্পই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হোক না কেন, তা নির্ধারিত বাজেট ও যথাসময়ে কখনোই শেষ করা যায় না। কেন শেষ করা যায় না, তার অনেক কারণ থাকে। বেশিরভাগ কারণই নেতিবাচক। প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দক্ষ জনবলের অভাব, যথাযথ মনিটরিং ও মূল্যায়নের অভাব থেকে শুরু করে সময়ক্ষেপণ এবং দুর্নীতির বিষয়টি এর পেছনে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে, যত বড় প্রকল্প, তত বেশি দুর্নীতির সুযোগ। প্রকল্পের সাথে যারা জড়িত থাকুক না কেন, তাদের অজুহাতের শেষ থাকে না। দেখা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগের আগেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য গাড়ি ক্রয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে প্রকল্পের বিরাট একটা অংশ ব্যয় হয়ে যায়। এ যেন ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া। এর কারণ হচ্ছে, যত ক্রয়, তত দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করা। সাধারণত একটি প্রকল্প শুরুর আগে এর দ্রæত বাস্তবায়নের সার্বিক দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে পরিকল্পনা করা স্বাভাবিক। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। অর্থ বরাদ্দ থেকে শুরু করে প্রকল্প বাস্তবায়নে অজুহাতের কোনো শেষ থাকে না। সময় মতো অর্থছাড় না হওয়া একটা সমস্যা হলেও অর্থছাড়ের পরও দেখা গেছে, প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয় না। শুরু হলেও তা এতটাই শম্ভুক গতিতে চলে যে নির্দিষ্ট সময় দূরে থাক, বর্ধিত সময়েও শেষ করা যায় না। সরকার যে ১০টি ফাস্টট্র্যাক প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সঙ্গত কারণেই সেগুলো বাস্তবায়নে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হবে এবং সময় মতো যথাযথভাবে শেষ করার কথা। দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিক এই ১০ প্রকল্পের কাজ সবচেয়ে ধীর গতিতে এগুচ্ছে। এর ১০টি কারণও চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বৈদেশিক পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব, অনাপত্তিপত্র প্রাপ্তিতে দেরি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঠিক সময়ে সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা না দেয়া, প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষ জনবলের অভাব। এগুলোর সাথে নতুন যুক্ত হয়েছে বিদেশি অর্থছাড় কমে যাওয়া। প্রকল্পগুলো হাতে নেয়ার সময় এসব সমস্যা যে হতে পারে, তা কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে, তাই এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের শুরুতে এসব সমস্যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করে যদি কাজ শুরু করা যেত, তবে এই দৈন্যদশায় উপনীত হতো না। সবচেয়ে বড় কথা, প্রকল্পগুলো সরকারের এজেন্ডা অনুযায়ী নিজস্ব উদ্যোগে হচ্ছে। এক্ষেত্রে তো কোনো ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক হয়ে যাওয়ার কথা। অর্থ একটি বড় কারণ হলেও প্রকল্পের শুরুতেই তার উৎস নিশ্চিত করার কথা। কোনো কারণে সংকট দেখা দিলে, তার বিকল্প সংস্থানও বিবেচনায় রাখা দরকার। যেহেতু এসব প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে, তাই এ সংশ্লিষ্ট সকল সমস্যা এবং সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলায় যথাযথ প্রস্তুতি থাকা অপরিহার্য। বোঝা যাচ্ছে, প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরনের সংকট মোকাবেলায় দূরদর্শী চিন্তার অভাব ছিল।
যে সকল প্রকল্পের সাথে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতি জড়িয়ে আছে, সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি সরকারের ইমেজের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি দেশের ভাবমর্যাদার জন্যও ক্ষতিকর। এসব প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়িত না হলে দেশের মানুষের কাছে সরকারের এ যাবতকালের সব কথা ‘বাগাড়ম্বর’ বলে প্রতিপন্ন হবে। কথা ও কাজে মিল নেই- এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য প্রলম্বিত হয়ে পড়বে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এখন পর্যন্ত মেগা প্রকল্পগুলোর যে অগ্রগতি তা খুবই হতাশাজনক। আমরা মনে করি, প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কাজ কেন ধীর গতিতে হচ্ছে এবং গলদ কোথায়, তা সরকারের মনিটর করা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে কারো গাফিলতি ও উদাসীনতা রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার। ফাস্টট্র্যাক বা অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি যদি ধীর হয়, তবে অন্য প্রকল্পের কী অবস্থা, তা ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নের এ ধরনের চিত্র দেশের দ্রুত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্দক। ধীর গতির এ অপসংস্কৃতি থেকে সংশ্লিষ্টদের বের হয়ে আসতে হবে। প্রকল্পের শুরুতে যেসব সমস্যা দেখা দেয়, সেগুলো দ্রুত সমাধান করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। দ্রুত অর্থছাড়, দক্ষ জনবল ও কর্মঠ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আগে থেকেই নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন