শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

তিন যুগে ৭০ হাজার হেক্টর পুকুর-খাল উধাও

১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজার, এখন এক শ’: পানিবদ্ধতা ও পানি সঙ্কট চরমে

| প্রকাশের সময় : ১৮ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : উধাও হয়ে গেছে ঢাকার পুকুর-খাল-ঝিল। ভরাট হতে হতে ঢাকায় পুকুর-খাল-ঝিল এখন নেই বললেই চলে। সরকারি হিসাবে ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজার। ২০০৭ সালে তা কমে দুই শ’তে ঠেকেছে। গত ১০ বছরে এই সংখ্যা এক শ’র কিছু বেশি হবে বলে ধারণা করা হয়। একটি বেসরকারি সংগঠনের হিসাব মতে, গত তিন যুগে ঢাকা হারিয়েছে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর পুকুর-খাল-ঝিল। ওই সংগঠনের জরিপে দেখা যায়, ৩৮ বছর আগেও রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকার পুকুর-খাল-ঝিল ছিল সাড়ে তিন হাজার হেক্টরের মতো। গত দেড় যুগে এর পরিমাণ কমেছে ৮৪ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সচেতনতা এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার অভাবে নগরীর পুকুর-খাল-ঝিল হারিয়ে গেছে। নগর উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক সংস্থা এবং সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়হীনতার কারণে পুকুর-খাল-ঝিল ভরাট ও দখল বন্ধ করা যাচ্ছে না। ঢাকা ও আশপাশের এলাকা নিয়ে ড্যাপ ঘোষণা করা হলেও পুকুর-খাল রক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। প্রয়োজনীয় পুকুর-খাল-ঝিল না থাকায় ঢাকায় অল্প বৃষ্টিতেই পানিবদ্ধতা এবং গ্রীষ্মকালে পানি সঙ্কট দেখা দেয়। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, রাজধানীকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই পুকুর-খাল-ঝিল সংরক্ষণ করা দরকার। তিনি বলেন, পুকুর-খাল-ঝিল সংরক্ষণের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। এ সংক্রান্ত আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। সরকারের উচিত, আইনকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করা।
মৎস্য অধিদফতরের এক জরিপে দেখা যায়, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুরের সংখ্যা ছিল দুই হাজার। ১৯৮৯ সালের দিকে সেটা কমে ১২ শ’তে নেমে আসে। ২০০৭ সালে মৎস্য ভবন থেকে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, পুকুরের সংখ্যা দুই শ’। গত ১০ বছরে সেগুলো কমে এক শ’তে এসে ঠেকেছে বলে ধারণা করা হয়। যদিও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান দাবি করেছেন, ঢাকায় এখনো পুকুরের সংখ্যা এক শ’র বেশি হবে। ঢাকা শহরে পুকুরের সঠিক সংখ্যার হিসাব নেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে। তবে অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের ২০০৮ সালের এক জরিপে বলা হয়, রাজধানীতে একসময় ৪৪টি খাল ছিল। যার মধ্যে ৩৫টি খাল শুকিয়ে গেছে। অনেক খাল ভরাট করে সড়ক, ড্রেনেজ লাইন করা হয়েছে।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী জামশেদের বয়স ৮০ বছরের উপরে। জন্মসূত্রে ঢাকায় বসবাস করছেন। তিনি জানান, এক সময় ঢাকা শহরে বহু পুকুর ছিল। কোথাও একটি পুকুর, কোথাও জোড়া পুকুর। শাহবাগে বড় দু’টি পুকুর ছিল, যার একটি আজিজ সুপার মার্কেট এবং অন্যটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজিব হল ও জিয়া হল করা হয়েছে। আজিজ সুপার মার্কেটের পশ্চিম পাশেও একটি পুকুর ছিল, যেখানে পাওয়ার হাউজ করা হয়েছে। শান্তিনগরের পীর সাহেবের গলিতে বড় একটি পুকুর ছিল। চারদিক থেকে ভরাট করার কারণে এটা এখন ছোট ডোবায় পরিণত হয়েছে। জিগাতলা, রায়েরবাজার এলাকায় অনেক ডোবা ছিল। সেগুলো ভরাট করে বড় বড় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকার ইতিহাস ঘেটে এবং বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাসাবো, খিলগাঁও ও রাজারবাগ এলাকার বেশ কয়েকটি পুকুর ছিল। গত কয়েক যুগে সেগুলো ভরাট করা হয়েছে। তবে এসব এলাকার বেশির ভাগ পুকুর ভরাট করা হয়েছে সরকারিভাবে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুকুর, কমলাপুর রেল স্টেশনের পূর্ব দিকে রেলের ঝিল, আহমদবাগ এলাকার ঝিলের জায়গায় গড়ে উঠেছে দালানকোঠা। খিলগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী পুকুর ভরাট করে বানানো হয়েছে খেলার মাঠ। পুরান ঢাকার শত বছরের ঐতিহ্য সিক্কাটুলী পুকুরটিও হুমকির মুখে।
তবে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী এলাকারও একই অবস্থা। গুগলে ২০০৩ সালের চিত্রে দেখা যায়, ঢাকার পার্শ্ববর্তী আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, নরসিংদী এলাকায় বিস্তীর্ণ খাল-বিল ও পুকুর। তবে ২০১৫ সালের চিত্রে বেশির ভাগ পুকুর-বিল-ঝিল ভরাট দেখা যায়। আর বর্তমান চিত্র দেখলে মনেই হবে না এখানে কখনো খাল-বিল-পুকুর ছিল। ঢাকার চারপাশের চার নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর আশপাশে বেশির ভাগ খাল-বিল-পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়েছে। সেগুলো গড়ে উঠেছে বড় বড় শিল্প কারখানা অথবা বহুতল ভবন।
তারপরও এখনো ঢাকায় টিকে আছে বেশ কিছু পুকুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুরটি এখনো আছে। যদিও এই পুকুরটি ভরাট করার জন্য বহু কুসংস্কার ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ওই পুকুরে গোসল করতে গেলেই মানুষ মারা যায়। এখনো পুকুর পাড়ে সতর্কবাণী টানানো আছে। রমনা পার্কের পুকুর নগরীর সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে এখনো টিকে আছে। টিকে আছে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুকুরটি। কদমতলা-রাজারবাগের গঙ্গাসাগর দীঘিটিও এখনো আছে। সবুজবাগের বৌদ্ধবিহারের পুকুরও উন্মুক্ত রয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য। পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলি-ইসলামপুরের নবাববাড়ির পুকুর আগের মতোই আছে। তবে সেখানে নামতে হলে টাকা খরচ করতে হয়। পুরান ঢাকার বংশাল পুকুরে রয়েছে সিঁড়িসহ দু’টি ঘাট। বংশালের পুকুরটি ছয় বিঘা জমির ওপর কাটা।
আছে নওয়াব আবদুল বারীর পুকুর। আহসান মঞ্জিল পরিবারের নওয়াব আবদুল বারীর খননকৃত বিশাল পুকুর। ১৮৩৮ সালে এটা খনন করা হয়। অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী এই গোল পুকুর। বড় বড় বিল্ডিংয়ের আড়ালে একখন্ড কোমল স্নিগ্ধতা এই পুকুর। এই পুকুর পরিচালিত হচ্ছে মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের তত্ত¡াবধানে।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, এক সময় ঢাকার খালগুলোর সঙ্গে আশপাশের চারটি নদীর সংযোগ ছিল। সুত্রাপুর থেকে লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, মোহাম্মদপুরের বসিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরা-আবদুল্লাহপুর হয়ে তুরাগ, উত্তরখান হয়ে তুরাগ, খিলক্ষেত ডুমনি হয়ে বালু ও মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে চলাচল করা যেতো। বুড়িগঙ্গা নদীর বসিলা থেকে ধানমন্ডি, তেজগাঁও, রামপুরা হয়ে তুরাগে মিলেছিল শুক্রাবাদ খাল। এই খালের রায়ের বাজার, জিগাতলা ও শুক্রাবাদ এলাকায় এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। মোহাম্মদপুর ও পিসিকালচার হাউজিংয়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত কাটাসুর খালটি এখন মরা। সেগুনবাগিচা খালটি একসময় পান্থপথ থেকে শুরু হয়ে হাতিরপুল, রমনা হয়ে সেগুনবাগিচা, বিজয়নগর, আরামবাগ, কমলাপুর, মানিকনগর, ডেমরা হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে মিলেছিল। ঢাকার অন্যতম বড় খাল বেগুনবাড়ি খালের মাঝখানের অংশ হয়েছে হাতিরঝিল। খালটি পান্থপথ থেকে শুরু হয়ে সোনারগাঁও হোটেলের পেছন দিয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকা হয়ে রামপুরা ব্রিজের তলদেশ দিয়ে বনশ্রী ও আফতাব নগরের মধ্য দিয়ে বালু নদীতে গিয়ে মিলেছে। এ খালের একটি অংশ মহাখালী বাস টার্মিনালের পাশ দিয়ে নাখালপাড়া-পাগলাপুল হয়ে পুরাতন বিমানবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
অন্য দিকে, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আদাবর ও বায়তুল আমান হাউজিং এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল কল্যাণপুর খাল। একসময় এ খাল তুরাগ নদীর সাথে যুক্ত ছিল। কিন্তু মোহাম্মদপুর-গাবতলী বেড়িবাঁধের কারণে গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়। এখন খালের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। স্যুয়ারেজ লাইনের সাথে একাকার হওয়ায় এর দুর্গন্ধময় পানি এলাকাবাসীর জন্য দুঃসহ যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবদুল্লাহপুর খালটি হরিরামপুর, রানাভোলা, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, দলিপাড়া হয়ে বাউনিয়ায় গিয়ে মিলেছিল।
এ ছাড়াও মিরপুরের পল্লবী এলাকা ঘেঁষে বাউনিয়া খাল, পল্লবীর রূপনগর, বোটানিক্যাল গার্ডেনের উত্তর প্রান্ত দিয়ে যাওয়া দ্বিগুণ খাল, খিলগাঁও, বাসাবো ও সবুজবাগ এলাকা দিয়ে প্রবাহিত খিলগাঁও খাল, মুগদাপাড়া, জিরানী ও সবুজবাগ দিয়ে যাওয়া জিরানী খাল, মান্ডা, গোলাপবাগ, মানিকনগর এলাকা দিয়ে যাওয়া মান্ডা খালের কোনো অস্তিত্ব নেই। মিরপুর কসাইবাড়ি ও বোয়ালিয়া এলাকা দিয়ে প্রবাহিত বোয়ালিয়া খাল, খিলক্ষেত পাতিরা ও ডুমনি এলাকার সুতিভোলা খালের ৬০ ভাগেরই কোনো অস্তিÍত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
MD Elias ১৮ মার্চ, ২০১৭, ১১:১৭ এএম says : 0
thanks for this news
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন