শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহানগর

চট্টগ্রামে হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য

v

প্রকাশের সময় : ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : ময়লা আবর্জনায় ভরা স্যাঁতস্যাতে ফ্লোর। তাতে ফেলে একসাথে কাটা হচ্ছে তেলাপিয়া মাছ আর মুরগি। পাশেই পাটায় বাটা হচ্ছে মসলা। মাছ, গোশতের রক্ত, ময়লা, ফ্লোরের পানি আর মসলার পানিতে মাখামাখি পুরো ফ্লোর। খালি পায়ে সেখানে হাঁটছিল হোটেল কর্মীরা। চারিদিকে ভন ভন করছে মশা-মাছি। এ দৃশ্য চট্টগ্রাম মহানগরীর এনায়েত বাজার মোড়ের ক্যাফে জুবিলী হোটেলের।
গতকাল (রোববার) সকালে সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল আমীন। গা ঘিনঘিন করা এ দৃশ্য দেখে চমকে উঠেন ম্যাজিস্ট্রেট। হোটেল ম্যানেজারকে তার প্রশ্ন, ‘খালি ফ্লোরে ময়লার মধ্যে রেখে মাছ গোশত কাটাকুটি করছেন কেন?’ ম্যানেজারের জবাব, ‘স্যার ক্ষমা চাচ্ছি।’ এরপর ম্যাজিস্ট্রেট এগিয়ে যান রেস্টুরেন্টের ফ্রিজের দিকে। ডিপ ফ্রিজ খুলে দেখেন সেখানকার অবস্থা আরও ভয়াবহ। পরোটার খামিরের সাথে কাঁচা গোশত রাখা। গোশতের রক্তে লাল হয়ে গেছে পরোটার খামির। ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশ্ন, ‘এত নোংরা কেন?’ ম্যানেজার বললেন, ‘সরি, স্যার।’ ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘পরোটার খামির আর কাঁচা গোশত কি একসাথে রাখা যায়?’ ফের সরি বলেন ম্যানেজার।
কাঁচা মাছ আর ভাজা মাছ একসাথে রাখা হয়েছে ফ্রিজে তা থেকে পচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। পরোটার খামির থেকেও পাওয়া যাচ্ছিল দুর্গন্ধ। হোটেল ম্যানেজার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে আশ্বস্ত করেন এমন পচা খাবার আর রাখা হবে না। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপস্থিতিতে নষ্ট খাদ্যসামগ্রী নালায় ফেলে ধ্বংস করা হয়। এ সকল অনিয়মের জন্য হোটেল ক্যাফে জুবিলীকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এরপর নগরীর জামালখান মোড়ের দাওয়াত রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায় একই আদালত। অভিযানকালে দেখা যায় দাওয়াত রেস্টুরেন্টে মাছ-গোশত সংরক্ষণের জন্য যে ফ্রিজ ব্যবহার করা হচ্ছে তা অত্যন্ত নোংরা। মিনারেল ওয়াটারের বোতলের (৫০০ মিলি) গায়ে মূল্য লেখা আছে ১৫ টাকা। কিন্তু গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। অন্যদিকে সেভেন আপের বোতলে মূল্য লেখা রয়েছে (২০০মিলি) ১৫ টাকা তারা মূল্য নিচ্ছেন ২৫ টাকা। এসব অপরাধে দাওয়াত রেস্টুরেন্টকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
মহানগরীর ব্যস্ততম ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ওই দু’টি রেস্টুরেন্টের মতই বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টে এভাবে নোংরা পরিবেশে পচাবাসি খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এসব খাবার খেয়ে নানান অসুখ এবং পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে খাওয়ার অযোগ্য কিছু খাদ্যসামগ্রী ধ্বংস আর রেস্টুরেন্ট মালিককে জরিমানা করা হলেও সবকিছু চলে আগের মত। মহানগরীর বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টের পরিবেশ নোংরা এবং অপরিচ্ছন্ন। পচাবাসি খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে নিয়মিত। হোটেল-রেস্টুরেন্টে রান্নাবান্নায় ব্যবহৃত পানি, মসলা থেকে শুরু করে সবকিছুই নিম্নমানের। কোন কোন রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে মরা ছাগল আর মরা মুরগি পরিবেশনেরও অভিযোগ রয়েছে। হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর রান্নাঘরের অবস্থা খুব বেশি অপরিচ্ছন্ন। রান্নাঘরেই গোসল সারে বাবুর্চি থেকে শুরু করে হোটেল বয়রা। রান্নাঘরের পাশেই হোটেলের গণটয়লেট।
নিয়মিত হোটেলে খান এমন লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে দুপুর এবং রাতের খাবার সবকিছুতেই বাসি খাদ্যসামগ্রী পরিবেশ করা হচ্ছে। এমনকি চায়েও ভেজাল মেশানো হয়। বাসি ডাল, বাসি তরকারির সাথে নতুন করে সবজি দিয়ে তরকারি রান্না করা হয় বেশিরভাগ হোটেলে। মাছ, গোশত থেকে শুরু করে সবকিছুতেই দেওয়া হয় নিম্নমানের ভেজাল মসলা। পোড়া তেলে ভাজা এবং রান্না হয় তরকারি। সম্প্রতি ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে নামকরা কয়েকটি রেস্টুরেন্ট থেকে দীর্ঘদিনের পুরনো পোড়া তেল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে। মাসের পর মাস ওই সিরায় তৈরি হয় জিলাপি ও হরেক রকম খাদ্যসামগ্রী। ডালডার সাথে চিনি মিশিয়ে তা বাটার বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। মহিষের গোশত রান্না করে বিক্রি করা হয় গরুর গোশত বলে। ছাগলের গোশতেও ভেজাল। হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার রান্না এবং পরিবেশনে নিয়োজিত হোটেল শ্রমিকদের অবস্থা আরও নাজুক। তারা নিজেরাই নানান রোগে আক্রান্ত। অসুস্থ শরীর আর ময়লা কাপড় পরে তাদের খাবার পরিবেশন করতে দেখা যায়।
হোটেল-রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি বেকারীগুলোতেও চলছে পচাবাসি আর ভেজালের কারবার। সম্প্রতি নগরীর নামকরা বেশ কয়েকটি বেকারীতে অভিযান চালিয়ে চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পচাবাসি আর নিম্নমানের খাওয়ার অনুপযোগী উপাদানে বেকারী সামগ্রী তৈরির প্রমাণ পেয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। কয়েকটি বেকারী থেকে বিপুল পরিমাণ নিম্নমানের খাদ্যসামগ্রী পোড়া তেল, সিরা জব্দ করে নর্দমায় ফেলে ধ্বংস করা হয়েছে। মোবিল জাতীয় পোড়া পাম অয়েলে ভাজা হয় খাদ্যসামগ্রী। ডালডার সাথে চিনি মিশিয়ে তা বাটার বলে চালিয়ে দেওয়া হয় বেকারী সামগ্রী। রেয়াজুদ্দিন বাজার ও লালখান বাজারে দু’টি বেকারীতে মাসের পর মাস পড়ে থাকা চিনির সিরা, পোড়া তেল জব্দ করে ভ্রাম্যমান আদালত। এসব তেলে প্রতিদিনই ভাজা হচ্ছিল নিমকি, জিলাপিসহ নানান মুখরোচক খাদ্যসামগ্রী। বেশিরভাগ বেকারীতে ব্যবহার করা হয় খাবার অনুপযুক্ত রং। মহানগরীর ডিমের আড়তের ভাঙা আর পচা ডিমের শেষ ঠিকানা যেন এসব বেকারী। এসব পচা ডিমে তৈরি হয় কেক, বিস্কিটসহ।
সম্প্রতি মহানগরীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু হয়। এ পর্যন্ত পরিচালিত অভিযানে মহানগরীর প্রায় সবকটি হোটেলেই নোংরা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেখতে পেয়েছে ভ্রাম্যমান আদালত। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল আমীন এসব অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি জানান, হাতেগোনা দু’একটি হোটেল ছাড়া বেশিরভাগ হোটেল-রেস্টুরেন্টে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখা যায়নি। পচাবাসি খাবার পরিবেশন এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। অভিযানের পর হোটেল মালিকদের মধ্যে সচেতনতা এসেছে বলে জানান তিনি।
মহানগরীতে জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ হোটেল-রেস্টুরেন্টে তিন বেলা খাবার গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে শ্রমিক ও নিম্নআয়ের লোকজন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে মেসে থাকা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকজন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের একটি অংশও হোটেল-রেস্টুরেন্টে নিয়মিত খাবার খান। পর্যটক ছাড়াও মামলা-মোকদ্দমাসহ বিভিন্ন কাজে গ্রাম থেকে এবং দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে আসা লোকজনও হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের উপর নির্ভরশীল। মহানগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় এমনকি অলিগলিতেও গড়ে উঠেছে হোটেল-রেস্তোরাঁ। নগরীর শিল্পাঞ্চলগুলোতে খোলা রাস্তার উপর বিক্রি হচ্ছে খাবার। বড় বড় ডেকচিতে রান্না করা খাবার এনে ফুটপাতে বিক্রি করছে হকারেরা। চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকায় ফুটপাতেই বসেছে অসংখ্য খাবারের দোকান। খোলা আকাশের নিচে রান্নাবান্না করে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এছাড়া মহানগরীর অলিগলি এবং হাটবাজারের ভেতরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল-রেস্তোরাঁ। এসব হোটেল-রেস্তোরাঁর বেশিরভাগেরই পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। কিন্তু লোকজন বাধ্য হয়ে এসব হোটেল-রেস্তোঁরায় খাবার গ্রহণ করছে। চিকিৎসকেরা জানান, প্রতিদিনই এসব হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার গ্রহণ করে লোকজন অসুস্থ হচ্ছে। অনেকে পেটের পীড়ায় ভুগছেন। নোংরা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে ভেজাল ও পচাবাসি খাবার খেয়ে মানুষের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে। কেউ কেউ কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাবার মান ও পরিবেশ তদারকির দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের কোন তৎপরতা চোখে পড়ে না। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ অভিযানে নামকরা সব হোটেল-রেস্তোরাঁর যে চিত্র উঠে আসে তাতে বুঝা যায় সাধারণ হোটেলগুলোর অবস্থা আরও কত নাজুক। ভোক্তা অধিকার সংগঠনের নেতারা বলেন, শুধুমাত্র একটি দু’টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান দিয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁর এসব অনাচার বন্ধ করা যাবে না। এ ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। এর পাশাপাশি ভোক্তাদেরও আরও বেশি সচেতন হতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন