নগরের পাশাপাশি গ্রামেও ঘরবাড়ি নির্মাণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন বা ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে আইন করতে যাচ্ছে সরকার। গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠকে ‘নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন-২০১৭’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং কৃষিজমি রক্ষায় এ ধরনের আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়া অনুসারে আইনের লঙ্ঘন বা অমান্য করে কোন ব্যক্তি বা সংস্থা অনুমোদনহীনভাবে বাড়িঘর, স্থাপনা নির্মাণ করলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সাথে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ এবং গণপূর্ত সচিবের নেতৃত্বে ২৫ সদস্যের নির্বাহী পরিষদ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। উল্লেখ্য, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় স্থাপনা নির্মাণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণের বিধান মান্য করা হলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সিটি কর্পোরেশনগুলোর কোন নিজস্ব নগর পরিকল্পনা না থাকায় কার্যত অনুমোদন নিয়ে গড়ে ওঠছে একেকটি অপরিকল্পিত নগরী। অন্যদিকে ছোট পৌরসভা ও গ্রাম পর্যায়েও বাড়িঘর নির্মাণে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অনুমোদন গ্রহণের আইন থাকলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তা মান্য করা হয়না। এখন নতুন আইনের আওতায় আইনের লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হলে তা’ যথাযথভাবে প্রতিপালিত হবে বলে আশা করা যায়।
একদিকে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য চাহিদাও ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। অন্যদিকে বর্ধিত মানুষের জন্য আবাসন, অবকাঠামো নির্মাণ এবং শিল্পায়নের প্রয়োজনে অকৃষিখাতে ভূমি চলে যাওয়া ও নানাবিধ দূষণের কারণে কৃষিজমির পরিমাণ এবং উর্বরতাও কমছে। খাদ্যনিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় কৃষিজমি ও জলাভূমি সংরক্ষণ রাষ্ট্রের একটি অগ্রাধিকার বিষয় হিসেবে গণ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। স্বাধীনতার পর থেকে অপরিকল্পিত ক্রমবর্ধমান নগরায়ন, শিল্পায়ন ও বাস্তু ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে দেশ। কৃষিজমি ও বনভূমি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় আইনগত নজরদারি না থাকায় লাখ লাখ একর কৃষিজমি ভূমিদস্যুতার শিকার হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থ া(এফএও)র ‘স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড ফরেস্ট-২০১৬’ প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে যে সব দেশে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে তার শতকরা ৭০ ভাগই কৃষিজমিতে যুক্ত হচ্ছে বলে জানা যায়। তবে এর মধ্যে ১৭টি দেশে একই সাথে কৃষিজমি এবং বনভূমি উভয়ই কমছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের নাম শীর্ষে রয়েছে। তবে আমাদের সরকার একদিকে নতুন বনভূমি গড়ে তুলতে বিশেষত উপকূলীয় এলাকায় নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করছে, অন্যদিকে কৃষিজমি এবং পুরনো ও সংরক্ষিত বনভূমি রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত ৩০ লাখ হেক্টর কৃষিজমি কমেছে।
কৃষিজমি ও বনভূমি রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা দীর্ঘদিন ধরে বলা হলেও এসব গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে আইন প্রণয়নের পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও নজরদারি গড়ে তোলা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। দেশে পরিবেশ অধিদফতর, বন ও কৃষিমন্ত্রণালয়, কৃষিসম্প্রসারণ অধিদফতরসহ জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক দফতর থাকার পরও গত সাড়ে চার দশকে দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন, বনভূমি ও কৃষিজমি ধ্বংস হওয়ার কারণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। সারাদেশে হাজার হাজার ইটভাটা গড়ে উঠেছে প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও পরিবেশগত সার্টিফিকেট ছাড়াই। অপরিকল্পিত ও অননুমোদিতভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটায় একদিকে যেমন পরিবেশদূষণকারী নিম্নমানের কয়লা, গাছ পোড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে লোকালয়ের কাছে এবং কৃষিজমির উপর গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো প্রতিদিন লাখ লাখ টন মহামূল্যবান টপসয়েল বা কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর মাটি পোড়ানো হচ্ছে। এভাবে টপসয়েল হারিয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি তার উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। এসব বন্ধ করতে নতুন আইনের প্রয়োজন নেই। বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগই যথেষ্ট। শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব আবাসন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করাই যথেষ্ট নয়। সেই সাথে প্রতিটি স্থানীয় প্রশাসনকে নিজ নিজ এলাকার জন্য বাস্তু পরিকল্পনা, পয়ঃ-পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। সারাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছতা দূর করতে হবে। বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভূমিদস্যুতা বন্ধে প্রশাসনকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বার এবং স্থানীয় দলীয় ক্যাডাররা যেন ঘরবাড়ি তুলতে ছাড়পত্র গ্রহণের প্রস্তাবিত আইনকে সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও জিম্মি করে সুবিধা আদায়ের হাতিয়ারে পরিণত করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আইনের প্রায়োগিক দিক নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন