জনগণের ওপর হাজার হাজার কোটি টাকার বাড়তি ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে সরকার বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করলেও প্রকল্পের কাজ শেষ হতে না হতেই নানাবিধ অব্যবস্থাপনার শিক্ষার হচ্ছে এসব প্রকল্প। নির্মীয়মাণ পদ্মাসেতুর কথা বাদ দিলে যমুনা বহুমুখী সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু) প্রকল্পই হচ্ছে এ যাবৎকালের বৃহত্তম সেতু প্রকল্প। যমুনা নদী দ্বারা বিভক্ত দেশের উত্তরাংশের সাথে রাজধানী ও অবশিষ্ট অংশের সেতুবন্ধন বঙ্গবন্ধু সেতু এখন যাতায়াতকারীদের জন্য বিপজ্জনক মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। এই সেতুর সংযোগস্থলে গত ৯ জানুয়ারী এক রাতের কয়েক ঘণ্টায় অন্তত: ৫টি ভয়াবহ দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এসব দুর্ঘটনায় একজন মন্ত্রীপুত্রসহ অন্তত: ৬ জনের মৃত্যু এবং এক ডজনের বেশী মানুষ আহত হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুতে একরাতে এত দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনার কারণ খুঁজে দেখতে গিয়ে দেখা গেছে, এর পেছনে রয়েছে সেতু ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সেতু বিভাগের অব্যবস্থাপনাও দায়িত্বহীনতা। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, উত্তরবঙ্গের গেটওয়ে এবং দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনার মেইনটেনেন্স বা ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের অনিয়ম ও গাফিলতি রয়েছে। সেতুর রাত্রিকালীন আলোর ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরা, নেভিগেশন লাইট, এয়ারক্রাফ্ট ওয়াকিং লাইট, সোডিয়াম লাইট, নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং টোল প্লাজার কম্পিউটার ইত্যাদি সবকিছুই অব্যবস্থাপনা ও বিচ্যুতির শিকার। জননিরাপত্তা এবং সেতুর নিরাপত্তাকে অগ্রাহ্য করে রাত্রিকালীন আলোর সব ব্যবস্থাই বন্ধ রাখা হয়েছিল বলেই ঘনকুয়াশায় একের পর এক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর পেছনে বিদ্যুৎ খরচ বাঁচানোর অজুহাত দেখানো হলেও মানুষের জীবন এবং সেতুর নিরাপত্তা যেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে তুচ্ছ।
যমুনা বহুমুখী সেতু প্রকল্প নব্বই দশকের প্রথমদিকে বিএনপি সরকার গ্রহণ করলেও এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এই স্বপ্নের সেতু নির্মাণ শেষে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের ৮ বছরের মাথায় ২০০৬ সালেই সেতুর মূল স্থাপনায় বড় ধরনের ফাটল ধরা পড়ে। সেতুর উপর দিয়ে মালবাহী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান পরিবহনের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা থাকলেও টোলপ্লাজা এবং নিরাপত্তা বিভাগের সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে অতিরিক্ত মালবোঝাই যানবাহন চলাচলের কারণে সেতুতে ফাটল সৃষ্টি হয়। তখন সেতুর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত কোম্পানীর একজন ইঞ্জিনিয়ার সেতুর ফাটলকে যমুনা সেতুর জন্য ক্যান্সার বা অমেরামতযোগ্য বলে অভিহিত করেছিলেন। এরপর সেতু মেরামতে নানাবিধ উদ্যোগের পাশাপাশি যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণেরও উদ্যোগ নেয়া হলেও সেতুর সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো অরক্ষিত, মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণই রয়ে গেছে। গত বছর দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৭ নম্বর সোডিয়াম লাইটটিসহ ১৫২টি সোডিয়াম লাইটের মধ্যে ১১২টিই অকেজো হয়ে আছে বলে ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে।
বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রাব্যয়ে নির্মিত একেকটি মেগা স্থাপনা একদিকে যেমন দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, অন্যদিকে এসব স্থাপনার ব্যয় নির্বাহ করতে বা খরচ পুষিয়ে নিতে দেশের জনগণকে বছরের পর বছর ধরে বাড়তি মাশুল গুণতে হচ্ছে। সেতু, ফøাইওভারের মত প্রতিটি মেগা স্থাপনা ব্যবহারকারিরা নির্ধারিত হারে টোল দিচ্ছে। সময়ে সময়ে টোলের হার বাড়ানো হলেও সেতু ও স্থাপনার ব্যবস্থাপনা নিরাপত্তায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি নেই বললেই চলে। অনিরাপত্তা ও অব্যবস্থাপনার কারণে যমুনা সেতু, তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের মত কেপিআই ওয়ান ক্যাটাগরির মেগা স্থাপনাগুলো এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিশাল ব্যয়সাপেক্ষ এ ধরনের মেগা প্রকল্প বার বার তৈরী ও মেরামতের বিষয় নয়। নিরাপত্তার শর্ত ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যুমনা সেতুতে যেমন অতিরিক্ত মালবোঝাই ট্রাক-কাভার্ডভ্যান চলাচল করছে, বছর ধরে লাইটিং ও নজরদারির ব্যবস্থা অকেজো থাকছে, সংযোগ সড়কগুলো চলাচলের অযোগ্য এবং মরণফাঁদে পরিণত হচ্ছে তেমনি দেশের বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজে ফাটল দেখা দেয়ার পর ২০১৪ সালে ব্যারাজের উপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও তা’ প্রায়শ মানা হচ্ছে না। নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা টাকার বিনিময়ে তিরিশ-চল্লিশ টন ওজনের ট্রাক ও মালগাড়ি চলাচলের সুযোগ দিয়ে ফাটলযুক্ত তিস্তা ব্যারাজকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সেতুতে ফাটল ও দুর্ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর তদন্ত কমিটি হয়, মেরামতের জন্য কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়; কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। কে কেন রাত্রে লাইট বন্ধ রাখে, সিসি ক্যামেরা কেন অকেজো থাকে, টোল প্লাজার কম্পিউটার ও গাড়ির ওজন মাপার স্কেল কেন কাজ করে না, এর সদুত্তর পাওয়া যায় না। যাদের দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্থাপনাগুলো অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন