শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জঙ্গিবাদের হুমকি : ব্লেম গেম বন্ধ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৭ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় জঙ্গি আস্তানায় পরিচালিত অভিযানের মধ্যেই জঙ্গি হামলা ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশসহ ৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন পুলিশ-র‌্যাবের সদস্যসহ অন্তত ৫০ জন। আহতদের মধ্যে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধানও রয়েছেন যার অবস্থা আশঙ্কাজনক। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের আরামবাগ থেকে দু’জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের তথ্যে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় আতিয়া মহল নামের একটি বহুতল ভবনে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যরা। বিষয়টি সিলেটের পুলিশ জানানো হলে পুলিশ ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যরা এলাকাটি ঘিরে ফেলে। জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু হয় বৃহস্পতিবার মধ্য রাতের পরে। জঙ্গিদের প্রতি আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু তারা এ আহ্বানে সাড়া না দিয়ে গুলিবর্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই সঙ্গে সোয়াত টিমের সদস্যদের সেখানে পাঠানোর আহ্বান জানায়। ঘটনা প্রবাহের এই প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা শুক্রবার সেখানে যায়। সেনাবাহিনী, ‘অপারেশন টোয়ালাইট’ নাম দিয়ে আতিয়া মহলে অভিযান চালায়। এই অভিযানে আতিয়া মহলের বিভিন্ন ফ্লাটে আটকে পড়া ৭৮ জনকে শনিবার দুপুর নাগাদ অক্ষতভাবে উদ্ধার করা হয়। পরিকল্পনা মতো আটকেপড়াদের কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সংবাদ সম্মেলন করার অল্পক্ষণ পরেই অদূরে প্রথম বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটে এরও কিছুক্ষণ পরে। প্রথম বিস্ফোরণের ঘটনাকে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা বলে ধারণা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিস্ফোরণের ঘটনা আত্মঘাতী না হলেও জঙ্গিদের পেতে রাখা বোমার বিস্ফোরণ বলে মনে করা হচ্ছে।
জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষ না হওয়ার আগেই এ ধরনের হামলা, বিস্ফোরণের ঘটনা এবং প্রাণহানি যে কোনো বিবেচনায় অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বোঝা যায়, জঙ্গিরা অত্যন্ত বেপরোয়া এবং নিশ্চিত মৃত্যু বা ধরা পড়ার মুহূর্তেও আক্রমণে দ্বিধাহীন, সক্রিয়। অন্যদিকে মনে হতে পারে, এত বড় একটা অভিযানের সময় যে ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল, সম্ভবত তার ঘাটতি ছিল। সংশ্লিষ্ট এলাকা আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর তীক্ষè নজরদারির মধ্যেই থাকার কথা। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও কঠোর হওয়ার কথা। এসব যথাযথভাবে থাকলে এই মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা হয়তো ঘটতে পারতো না। অবশ্য, এখন এ কথা বলে কোনো লাভ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান যে আরো সতর্কতা ও আরো নিখুঁত ব্যবস্থাপনা দাবি করে, এই ঘটনা থেকে সে উপলব্ধি জাগ্রত হলে সেটা হবে একটা বড় অর্জন। অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি, সাম্প্রতিককালে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিরসরাই-সীতাকুন্ডসহ রাজধানীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার সাক্ষ্য বহন করে। আমরা এও লক্ষ্য করছি, জঙ্গিরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করে আত্মঘাতী হামলার পথ বেছে নিয়েছে। এটা মারাত্মক আশঙ্কার বিষয়। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে বরাবরই জঙ্গি দমনে কৃতিত্ব দাবি করা হয়। বলা হয়, জঙ্গিবাদ হুমকি নয়, নিয়ন্ত্রণেই আছে। জঙ্গিদের কোমর ও নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ এই দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমরা এও লক্ষ্য করছি, আইএস কয়েকটি হামলার দায় স্বীকার করেছে যদিও সরকারের দাবি, আইএস বলে কিছু নেই। আইএস থাক বা না থাক, চলমান জঙ্গি তৎপরতায় জনগণের মধ্যে ব্যাপক শংকা ও আতংক দেখা দিয়েছে।
জাতীয় স্বার্থেই জঙ্গিবাদের মূলোৎপাঠন জরুরি। এ জন্য জাতীয় ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিকল্প নেই। দুঃখজনক হলেও আমরা দেখছি, জঙ্গিবাদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে দুষছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিকে জঙ্গি সঙ্গি বা জঙ্গি মদদদাতা হিসাবে চিহ্নিত ও চিত্রিত করার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে বিএনপির নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও সরকার জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। জঙ্গি হামলার ঘটনা অনুসন্ধান ও তদন্তে সরকার সময়ক্ষেপণ ও গড়িমসি করে জঙ্গিবাদকে জিইয়ে রাখছে। জঙ্গিবাদের কথা বলে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি করছে। একটি গুরুতর সমস্যা নিয়ে এই রাজনৈতিক ব্লেম গেম শুধু অনভিপ্রেত নয়, অত্যন্ত দুঃখনজক। জঙ্গিবাদকে যদি জাতীয় সমস্যা হিসাবে বিবেচনায় নেয়া হয় তাহলে জাতীয়ভাবেই তার মোকাবিলার পদক্ষেপ নিতে হবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐকমত্য রয়েছে। এই ঐকমত্যকে কাজে লাগিয়ে সমন্বিত কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও আলোচনার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া হলে দ্রæত সুফল পাওয়া সম্ভবপর হতে পারে। সরকারকেই এ ব্যাপারে অগ্রবর্তী ভূমিকা নিতে হবে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি দোষারোপ না করে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। সরকার জনগণকে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সহযোগিতা করার আহ্বান জানাচ্ছে। অথচ তাদের সংগঠিত করার কোনো উদ্যোগ নেই। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় দেশের আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখতে পারেন। তাদের কাজে লাগানোরও কোনো উদ্যোগ নেই। আমরা মনে করি, জাতীয় ও রাজনৈতিক ঐক্য ও সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব, এটা সরকারকে সবার আগে বুঝতে ও অনুধাবন করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন