শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

সুদ দুনিয়ার সকল ধর্মেই নিষিদ্ধ

প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ এক ॥
সাম্প্রতিককালে ইসলামিক ফাইনান্সবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে সম্মানিত স্কলারগণ প্রচলিত ব্যাংকের সুদকে হারাম জ্ঞান করেই এর বিকল্প হিসেবে মানুষের জীবনকে সহজতর ও আরামদায়ক করার লক্ষ্যে ‘প্রয়োজনীয়তার স্তর তত্ত্বের’ (ঞযবড়ৎু ড়ভ ষবাবষং ড়ভ হবপবংংরঃরবং) আলোকে মানুষের প্রয়োজনগুলোকে তিন স্তরে ভাগ করে (স্তরগুলো হলো- জরুরিয়াত বা অত্যাবশ্যকীয়, হাজিয়াত বা প্রয়োজনীয় ও তাহসিনিয়াত বা সৌন্দর্যবর্ধক) নতুন নতুন শরীয়াহ প্রোডাক্টের আইডিয়া বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। যা পরবর্তীতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের নিকট উন্নয়নের একটি মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্য, সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়ে থাকে।
সুপ্রাচীন কাল থেকে দুনিয়ায় আসমানী ধর্ম হিসেবে প্রচারিত সকল ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ ছিল। তাই সুদ প্রতিটি ধর্মেই হারাম। ইহুদি, খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মগ্রন্থেও সুদ নিষেদ্ধের বর্ণনা এসেছে পরিষ্কারভাবে। পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতি ওয়াজিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘বেবিলনীয় যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০-১৭১২) হাম্বুরাবি সংহিতায় সুদ লেনদেনসংক্রান্ত দৃষ্টান্তের অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হয়, সম্ভবত এর অনুকূলে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, ধর্মীয় অনুমোদন ছিল না। তবে হিন্দুধর্ম (মনুসংহিতা) এবং ইহুদী ও খ্রিষ্টধর্মে সুদকে হয় নিয়ন্ত্রণ করা হতো, না হয় রীতি মাফিক তা নিষিদ্ধ ছিল।’ তিনি আরো মন্তব্য করেছেন এভাবে, ‘মানব সভ্যতা যতটা পুরনো সুদের ধারণাটিও ততটাই প্রাচীন। সুদের ওপর আল-কুরআনের নিষেধাজ্ঞা কার্যত আহলি কিতাবদের (ইহুদি ও খ্রিস্টান) ওপর এই বিষয়ে পূর্ব থেকে আরোপিত ও প্রযোজ্য বিধিনিষেধের ধারাবাহিকতা মাত্র’। ঊীড়ফঁং- ২২ঃ২৪ (তাওরাত) এ বলা হয়েছে ‘তোমরা যদি আমার কোন লোককে অর্থ ধার দাও যারা গরীব, তবে তোমরা তার কাছে সুদ গ্রহীতার ন্যায় হয়ো না এবং তার কাছ থেকে সুদ আদায় করবে না’। চৎড়াবৎনং -২৮ঃ৮ তে বলা হয়েছে ‘যে সুদ এবং অন্যায় উপার্জনের দ্বারা তার সম্পদ-সম্পত্তি বৃদ্ধি করে, সে তা নিজের জন্য পুঞ্জিভূত করে যা দরিদ্রের দুর্দশা বাড়ায়’। খবারঃরপঁং: ২৫:৩৫-৩৭ তে বলা হয়েছে ‘ওভ ুড়ঁৎ নৎড়ঃযবৎ সববঃং রিঃয ফরভভরপঁষঃ ঃরসবং, ুড়ঁ ংযধষষ মরাব যরস ংযবষঃবৎ ধহফ ষড়ফমরহম, ঃযড়ঁময যব নব ধ ংঃৎধহমবৎ ড়ৎ ধ ংড়লড়ঁৎহবৎ, ঃযধঃ যব সধু ষরাব রিঃয ুড়ঁ. উড় হড়ঃ বীধপঃ ভৎড়স যরস ধহু রহঃবৎবংঃ (ৎরনধ) ড়াবৎ ধহফ ধনড়াব ঃযধঃ যিরপয ুড়ঁ যধাব ংঢ়বহঃ ড়হ যরস. ণড়ঁ যধাব ঃযব ধহমবৎ ড়ভ এড়ফ ঃড় ভবধৎ. ঝবব ঃড় রঃ ঃযধঃ ুড়ঁৎ নৎড়ঃযবৎ যধং ভৎববফড়স ঃড় ষরাব রিঃয ুড়ঁ. ওঃ রং হড়ঃ ঢ়বৎসরংংরনষব ভড়ৎ ুড়ঁ ঃড় ৎবপবরাব রহঃবৎবংঃ (ৎরনধ) ড়হ ঃযধঃ ুড়ঁ ংঢ়বহফ, ড়ৎ যিধঃ ৎিরঃব ড়ভভ.
খৃস্টান ধর্মগ্রন্থ ঞযব এড়ংঢ়বষ ড়ভ ঝঃ. খঁশব এ বলা হয়েছে, খধহফ, যড়ঢ়রহম ভড়ৎ হড়ঃযরহম ধমধরহ (ধার দাও, তার বিনিময়ে কিছু আশা না করে)। হিন্দুধর্মে ‘মনু’ এর (২য় শতাব্দী এডি) বিধিমালায় সুদের লেনদেন অবৈধ বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। প্রাচীন হিন্দু সমাজে একটি প্রবাদ চালু ছিল যে, ‘নগচ্ছেৎ শুন্ডিকায়লং’; অর্থাৎ সুদখোরের বাড়িতে যেয়ো না। বৌদ্ধ ধর্মেও সুদকে ঘৃণা করা হয়েছে এবং সুদখোরদের ‘ভ- তপস্বী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘যুঢ়ড়পৎরপধষ ধংপবঃরপং ধৎব ধপপঁংবফ ড়ভ ঢ়ৎধপঃরপরহম রঃ.’ প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক প্ল্যাটো তার ‘লজ’ নামক পুস্তকে সুদকে মানবতাবিরোধী, অন্যায় ও জুলুম এবং কৃত্রিম ব্যবসা বলে তীব্রভাবে বিরোধিতা করেছেন’। প্ল্যাটোর শিষ্য এরিস্টোটলও কঠোর ভাষায় সুদের নিন্দা ও বিরোধিতা করেছেন। তিনি অর্থকে বন্ধ্যা মুরগীর সাথে তুলনা করেছেন যা ডিম দিতে পারে না। তিনি তার পলিটিক্স শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ঞযব সড়ংঃ যধঃবফ ংড়ৎঃ (ড়ভ বিধষঃয), ধহফ রিঃয ঃযব মৎবধঃবংঃ ৎবধংড়হ, রং ঁংঁৎু, যিরপয সধশবং মধরহ ড়ঁঃ ড়ভ সড়হবু রঃংবষভ, ধহফ ভৎড়স ঃযব হধঃঁৎধষ ড়নলবপঃং ড়ভ রঃ. ঋড়ৎ সড়হবু ধিং রহঃবহফবফ ঃড় নব ঁংবফ রহ বীপযধহমব, ধহফ হড়ঃ রহপৎবধংব ধঃ রহঃবৎবংঃ ড়ভ ধষষ সড়ফবং ড়ভ মবঃঃরহম বিধষঃয, ঃযরং রং ঃযব সড়ংঃ ঁহহধঃঁৎধষ.’ সুদ মানবতার জন্য একটি জঘন্য অভিশাপ। সুদের অশুভ কালো হাত বা অনিষ্ট কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এর কুফল ও ধ্বংসকারিতা মানব জীবনের নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। ইসলাম কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট ও অকাট্য দলিল দ্বারা সূদকে হারাম করেছে এবং নিষিদ্ধ করণে অতি কঠোরতা দেখিয়েছে। এতে কোন চিন্তাবিদের চিন্তা কিংবা ইজতিহাদের সমর্থকের মন্তব্যের কোন স্থান নেই, কারণ যে বিষয়টি অকাট্য প্রমাণাদী দ্বারা সাব্যস্ত হয় তাতে ইজতিহাদ চলে না।
সুদের ভয়াবহ পরিণতি জানতে একজন মুসলমানের জন্য সূরা বাকারার শেষের দিকের আয়াতগুলো পাঠ করাই যথেষ্ট। আয়াতে কারিমায় নিহিত ভীতি প্রদর্শনের ভয়াবহতা ও শাস্তিদানের হুমকির তীব্রতায় তার বুকের মাঝে অবস্থিত হৃদয় বেরিয়ে যাবার উপক্রম হবে। আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন, ‘যারা সুদ খায় তারা সে ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এজন্য সে তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতই, অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন। যার কাছে তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার ব্যাপার আল্লাহর ইখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে তারাই অগ্নির অধিবাসী সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোন অকৃজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না। আর যদি তোমরা সুদ না ছাড় তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের (জন্য প্রস্তুত হও) ঘোষণা দাও। (আল কুরআন -২ঃ২৭৫-২৭৬) অসংখ্য হাদীসে রাসূল (সা.) সুদের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে সুদ খায়, যে খাওয়ায়, যে লেখে, যে স্বাক্ষী- সবাই অভিশপ্ত (তিরমিযি, আবু দাউদ)।
আরেকটি বর্ণনায় এসেছে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘মিরাজের রাজনীতে আমি সপ্ত আকাশে পৌঁছে যখন উপরের দিকে তাকালাম তখন বজ্রধ্বনি, বিকট ও প্রকট শব্দ শুনতে পেলাম। অতঃপর আমি এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট এলাম যাদের পেট ছিল একটি ঘরের ন্যায় বিস্তৃত। তাদের পেট ছিল সর্পে ভরপুর। সর্পগুলো বাহির থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হলো সুদখোর সম্প্রদায়’ (আহমদ, ইবনে মাযাহ)। রাসূল (সা.) আরেকটি হাদীসে বলেছেন, ‘সুদের ভেতর সত্তরটি গুনাহ রয়েছে, তম্মধ্যে সর্বনিম্ন গুনাহ হলো নিজের মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সমতুল্য’। (মেশকাত শরীফ) তিনি আরো বলেছেন, জেনেশুনে সুদের এক দিরহাম গ্রহণ করা ছত্রিশ বার যিনা করার চেয়ে মারাত্মক অপরাধ (বায়হাকী ও ইবনে মাযাহ)। আরেকটি হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সুদখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (মুসতাদরাকি হাকীম)। তিনি আরো বলেছেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সুদ সমৃদ্ধি আনে, কিন্তু সুদের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে অভাব ও সংকোচন। (মুসনাদে আহমদ)
আরবী পরিভাষায় যাকে ‘রিবা’ ইংরেজিতে যাকে টংঁৎু/রহঃবৎবংঃ, উর্দু, ফার্সি এবং বাংলায় তাকে ‘সুদ’ বলা হয়ে থাকে। সুদকে ব্যবহারিক বাংলায় ‘কুসিদ’ও বলা হয়। আরবী ‘বিরা’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- প্রবৃদ্ধি, বাড়তি, অতিরিক্ত, বিকাশ, সম্প্রসারণ, বিনিময় ছাড়া বৃদ্ধি প্রভৃতি। ইসলামে ঐ বৃদ্ধিকে ‘বিরা’ বলা হয় যা প্রদত্ত ঋণের উপর ঋণের শর্ত হিসেবে অতিরিক্ত ধার্য করে আদায় করা হয়। ড. ওমর চাপরা লিখেছেন, ‘রিবা সেই অতিরিক্তকে বুঝায় যা ঋণের শর্ত হিসেবে অথবা ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধির দরুন ঋণগ্রহিতা ঋণদাতাকে তার প্রদত্ত ঋণের আসলসহ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়’।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Mohsin Thakur ১ মার্চ, ২০১৬, ১২:১০ পিএম says : 1
Sud emon e ekti jogonno tomo pap,kunu bibek ban manus ei suder bebosay jorito hobena,
Total Reply(0)
KAMAL ১ মার্চ, ২০১৬, ৩:৫৫ পিএম says : 0
Right. Economy of Muslim world should be interest free.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন