যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই চালের দাম হু হু করে বাড়ছে। বেশি বাড়ছে মোটা চালের দাম, যার ক্রেতা স্বল্প আয়ের মানুষ। গত ক’দিনে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ২ টাকা থেকে ৪ টাকা। কয়েক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৮ টাকা থেকে ১০ টাকা। বছর খানেক আগে এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৩০ টাকা থেকে ৩২ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকা থেকে ৪৫ টাকা দরে। সরু চালের দামও এ সময়ে বেড়েছে। তবে বাড়ার হার তুলনামূলকভাবে কম। টিসিবির হিসাবে চালের দাম গত এক বছরে গড়ে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। ক্রেতাভোক্তাদের হিসাবের সঙ্গে টিসিবির হিসাবের অসঙ্গতি রয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের স্মরণ থাকার কথা, ভারত থেকে মোটা চাল আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর পর থেকেই চালের দামে উল্লম্ফন শুরু হয়, যা এখনো অব্যাহত আছে। চালের সঙ্গে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের দামও ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। মাছ, গোশত, ডিম, দুধ, ডাল, শাক-সবজি, তরিতরকারি, মসলাদ্রব্য- কোনো কিছুর দামেই স্থিতিশীলতা নেই। দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করা হয়। বাজারে চালের অভাব আছে কিংবা সরবরাহে কোনো সঙ্কট দেখা দিয়েছে, এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। গোশত ব্যবসায়ীরা তাদের ধর্মঘটের সময় বলে চাঁদাবাজি ও হাটগুলোতে অতিরিক্ত হাসিল আদায় বন্ধ হলে তারা প্রতি কেজি গরুর গোশত ৩০০ টাকায় বিক্রি করতে পারবে। সরকার তাদের কথায় কান দেয়নি। এখন গরুর গোশত ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এই কিছুদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৪০০ টাকা দরে। বাংলাদেশ বিশ্বে সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ উৎপাদনে চতুর্থ এবং গবাদি পশু ও পোলট্রিতেও তার অবস্থান ওপরে। অথচ সবকিছুর দামই আকাশছোঁয়া।
সামগ্রিক বিবেচনায় দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে খরা চলছে বহু দিন ধরে। কৃষি এবং শিল্পের দু-একটি উপখাত ছাড়া উৎপাদনে সুখবর নেই। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হাহাকার চলছে। উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে উল্টো অনেকে বেকার হয়ে পড়ছে। সরকারি চাকুরে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কিছু উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ছাড়া কারো বেতন বা আর্থিক সুবিধা বাড়েনি। মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের দিনযাপন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনো সঙ্গতি নেই। সংসারে টানাপড়েন নিত্য বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। শ্রমিক, দিনমজুরসহ বিত্তহীন মানুষের দুর্দশার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। দেশের অধিকাংশ মানুষ মোটাভাত-মোটা কাপড়ে সন্তুষ্ট। কোনো রকমে দিন গুজরান হলেই তারা যথেষ্ট মনে করে। এই অল্পে তুষ্ট মানুষেরা এখন দিন পার করতে হিমশিম খাচ্ছে। কষ্ট, অভাব ও হতাশা তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে ফেলছে। সরকারের তরফে দাবি করা হয়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। কিন্তু কত জনের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, কত জনের আয় বেড়েছে সে কথা বলা হয় না। কিছু লোকের ক্রয় ক্ষমতা অবশ্যই বেড়েছে, তবে তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। মাথাপিছু আয় বাড়ার গল্পের মধ্যে যে মস্তবড় শুভঙ্করের ফাঁক রয়েছে, তা কারো অজানা নেই। ক্ষমতাসীনরা উন্নয়নের জয়গান, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন ও ক্ষমতা সংহত এবং প্রলম্বিত করার কাজে ব্যস্ত। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা জেল-জুলুম ভোগ আর কোর্টকাছারিতে দৌড়াদৌড়ি করে সময় অতিবাহিত করছেন। জনগণের দুঃখ-কষ্ট ও সমস্যার প্রতি দৃষ্টি দেয়ার কারো কোনো সময় ও ফুরসুত নেই। তারা হয়ে পড়েছে নিরালস্ব।
চালসহ ভোগপণ্যের বাজারে সরকারের কোনো নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ নেই। বাস্তবে কোনো পণ্যেরই অভাব নেই। তারপরও সবকিছুরই দাম বাড়ছে। ঊর্ধ্বমুখী দামের ওপর লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। চালের দাম বাড়ার ব্যাপারে সেই পুরনো গল্পটাই নতুন করে শোনানো হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছে, পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে, পাইকারি বাজারওয়ালারা বলছে, ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছে মিলাররা দাম বাড়িয়েছে। এই গল্পে এরা সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। মিলারদের বক্তব্য হচ্ছে, তারা বলছে বাজারে ধান পাওয়া যাচ্ছে না, গেলেও দাম বেশি। প্রশ্ন হলো, এত ধান তাহলে কোথায় গেল? এর কোনো জবাব নেই। অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও গল্পটা প্রায় একই রকম। যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, জানা গেছে, সেসব পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। এলসি ও আমদানির হিসাবে সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। সব ধরনের পণ্যের অযৌক্তিক ও অকারণ দাম বাড়ার কারণে ক্রেতাভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সামনে আসছে রমজান মাস। রমজানে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। দামও বাড়ে। আমরা অতীতে লক্ষ্য করেছি, রমজানের আগেই ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। রমজানে সেই দামের ওপর আরো দাম বাড়ে। এবার যেন একটু আগেই দাম বাড়ানোর মহড়ায় নেমে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। রমজানে কি হবে, কে জানে! প্রশ্ন হলো, সরকার কি নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করে যাবে? বাজার অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজের হাত গুটিয়ে রাখবে? চালসহ সব ভোগ্যপণ্যের দাম কেন বাড়ছে, সরকারকেই তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তা এখনই। সরকার এ দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন