আর মাত্র দু’দিন পরই প্রথমবারের মতো ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশেষ আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর ১৩৬তম সম্মেলন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে এই সংস্থার সদস্যপদ লাভের ৪৫ বছর পর ঢাকায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আগামী পয়লা এপ্রিল থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য এই সম্মেলনে বিশ্বের ১৪০টি রাষ্ট্রের পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এমনি সময় ঢাকায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন বাংলাদেশ জঙ্গিবাদী হুমকির মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। সেই সাথে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রও এখন দেশে-বিদেশে নানা ধরনের প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখেও বাংলাদেশের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের ২৮তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং একই সাথে ১৩৬তম আইপিইউ সম্মেলনের ভেন্যু হিসেবে ঢাকাকে বেছে নেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি তৎপরতা ও নিরাপত্তাহীনতার দোহাই দিয়ে পশ্চিমা কিছু দেশ যখন বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক ক্রেতাদের একটি অংশ ঢাকায় সফর বাতিলের অজুহাত খাড়া করছে তখন এমন একটি প্রেস্টিজিয়াস আন্তর্জাতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠান আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে বিদ্যমান নেতিবাচক ধারণা অনেকটা বদলে দিতে পারে। রাষ্ট্রীয় ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারে এই সম্মেলনের সফল ব্যবস্থাপনা ও সমাপ্তি কার্যকর ভ‚মিকা রাখবে বলে আমরা আশাবাদী।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এটিই হবে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন, যেখানে প্রায় ১৪০টি দেশের সহস্রাধিক পার্লামেন্ট মেম্বার, সরকারি কর্মকর্তা এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবেন। ১৯৯৩ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে আইপিইউর ৮৯তম সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রায় ২৪ বছর পর দক্ষিণ এশিয়ার কোনো রাষ্ট্রে এই সম্মেলন হতে চলেছে। গত বছরের ২২-২৬ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আইপিইউর ১৩৫তম সামিট অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং চলতি বছরের ১৪-১৮ অক্টোবর রাশিয়ান ইউনিয়নের সেন্টপিটার্সবার্গে এর ১৩৭তম সম্মেলনের সূচি নির্ধারিত রয়েছে। সুইজারল্যান্ড এবং সেন্টপিটার্সবার্গের পাশাপাশি ঢাকার আইপিইউ সম্মেলন বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের কাছে তুলনামূলক বিচার্য বিষয়ে পরিণত হবে। বিশেষত ইতঃপূর্বে ভিয়েতনাম, জাম্বিয়া, ইথিওপিয়া, ব্যাংকক, উগান্ডাসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনগুলোর সাথে ঢাকার আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার একটি তুলনামূলক মূল্যায়ন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসতে পারে। এ কারণেই ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য এই সম্মেলনের সফল পরিসমাপ্তি আগামী দিনে বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ইন্টার পার্লামেন্টারি ক‚টনীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করতে পারে। আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরীও এই সম্মেলনকে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং সক্ষমতা প্রদর্শনের শোকেস হিসেবে ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছেন।
চলমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে এ ধরনের একটি হাইপ্রোফাইল সম্মেলন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জিং ইস্যু। বিশেষত শতাধিক দেশ থেকে আগত পার্লামেন্ট সদস্যসহ সহ¯্রাধিক অতিথির নিরাপত্তা, আবাসনসহ ৬ দিনের এই সম্মেলনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। সম্মেলনের মূল ভেন্যু হিসেবে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজাকে বেছে নেয়া হলেও মূল অধিবেশনগুলো অনুষ্ঠিত হবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। বাংলাদেশ সংসদ সচিবালয় এবং আইপিইউর যৌথ আয়োজনে এই সম্মেলনে মূল অধিবেশন ছাড়াও বৈশ্বিক-রাজনৈতিক, মানবিক ইস্যুগুলোর ওপর অনেকগুলো সেশন ও প্রেস কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হবে। উল্লেখ্য, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশ কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনেরও (সিপিএ) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। সিপিএর ৬২তম সম্মেলন ২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও জঙ্গিবাদী হুমকি এবং কয়েকটি পশ্চিমা দেশের ঢাকায় ভ্রমণ সতর্কতা জারির কারণে সে সম্মেলন বাতিল করা হয়েছিল। এ কারণেই সিপিএর চেয়ে বৃহৎ পরিসরের আইপিইউ সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে কিছু সংশয় কাজ করেছিল। চলতি মাসের শুরু থকে হঠাৎ করে দেশে আবারো জঙ্গিবাদী হুমকি প্রকট হয়ে ওঠায় এ ধরনের সংশয় কিছুটা রয়েই যাচ্ছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, সরকারের এই নিরাপত্তাব্যবস্থায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরাও আস্থাশীল রয়েছেন। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবেই চিহ্নিত। জাতিসংঘের নেতৃত্বে বিশ্বশান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী যেমন আন্তর্জাতিক সুনাম অর্জনে সক্ষম হয়েছে, একইভাবে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসের হুমকিও আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সাফল্যের সাথেই মোকাবেলায় সক্ষম হচ্ছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য আইপিইউ সম্মেলনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধিবৃন্দ, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের আবাসিক প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে রোহিঙ্গা সমস্যা, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানিতে বিদ্যমান সঙ্কট উত্তরণের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আমরা আশাবাদী। আমরা এই সম্মেলনের সার্বিক সাফল্য কামনা করছি। সর্বোপরি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানাভাবে ক্ষুণœ হওয়া দেশের ইমেজ পুনরুদ্ধারে আইপিইউ সম্মেলনকে সফলভাবে কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও আশা করছি। এ লক্ষ্যে ঢাকায় আগত আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ও গণমাধ্যমকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন