সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অবৈধ বিদেশীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে

প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দেশে কত সংখ্যক বিদেশী কাজ করে, তাদের মধ্যে কতজন বৈধভাবে আর কতজন অবৈধভাবে কাজ করে, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে বৈধাবৈধভাবে কর্মরত বিদেশীরা কোথায় থাকে, কী কী করে, কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা স্ব স্ব দেশে প্রেরণ করে Ñ এসব বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই। দেশের সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষই কোনো বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারে না। এটা একই সঙ্গে বিস্ময়কর, দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক। বিভিন্ন সূত্র-উৎস থেকে যতদূর জানা যায়, বৈধ কাগজপত্র নিয়ে কর্মরত বিদেশীর সংখ্যা ১৬ হাজারের মতো। আর অবৈধভাবে কর্মরতদের সংখ্যা ১২ লাখের ওপর। বৈধাবৈধ কর্মরতদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যাই বেশি। এ সংখ্যা ৫ লাখের মতো। গার্মেন্ট, বহুজাতিক কোম্পানি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার স্টেশন, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, খাদ্যোৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফোন কোম্পানি, বিজ্ঞাপনী সংস্থা এমনকি পার্লারেও কাজ করছে বিদেশীরা। এসব প্রতিষ্ঠানের উচ্চ ও মধ্যম স্তরে তারা কর্মরত রয়েছেন। প্রধানত বিদেশী এক্সপার্ট হিসেবে তারা কর্মরত। গার্মেন্টে রয়েছে সবচেয়ে বেশি বিদেশী। তাদের সংখ্যা ১০ লাখের মতো। বিদেশীদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা বেশি হলেও অন্য প্রায় ৫৫টি দেশের নাগরিক এখানে কাজ করছে। তারা সবাই মিলে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে। এ কথা কারো অজানা নেই, বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। তাদের একটা বড় অংশ অড জব করছে। তারা সবাই মিলে প্রতিবছর দেশে যে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে, তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী কর্মরতরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত বছর বিদেশী কর্মরতদের সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়েছে। তারা ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেতন-ভাতা গ্রহণ করছে। গত বছর রেমিটেন্স এসেছে ১৫.৩১ বিলিয়ন ডলার। এ তো কেবল দু লাখের হিসাবে। ১২ লাখের হিসাবে কত বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে, সেটা আন্দাজ করা কঠিন নয়। উল্লেখ করা আবশ্যক, অবৈধ বিদেশী কর্মরতদের আয়কৃত অর্থ প্রধানত হুন্ডির মাধ্যমে তাদের দেশে চলে যায়।
বাংলাদেশ অতিরিক্ত শ্রমশক্তির দেশ। কর্মসংস্থানের অভাব প্রচ-। অন্তত ৬ কোটি শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষ বেকারত্বের দুঃসহ জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। বিদেশে কর্মসংস্থানের আশায় তারা কী না করছে! অস্বাভাবিক ও অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার সময় তাদের অনেকে সাগরে ডুবে মরছে, বন-জঙ্গলে অনাহারে মরছে, কিংবা জিম্মি হয়ে অকথ্য নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আইএলও’র হিসাবে প্রতি বছর বাংলাদেশে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এই যখন বাস্তবতা, তখন লাখ লাখ বিদেশী বৈধাবৈধভাবে একানে কাজ করছে এবং দিনকে দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে। এতে বেকারত্বের চাপই বাড়ছে না, সেইসঙ্গে বিশাল অঙ্কের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। সহজ কথায় বলা যায়, লাভের ধন পিঁপড়ায় খেয়ে যাচ্ছে। এছাড়া আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো, বিদেশীদের মধ্যে বহু লোক বিভিন্ন অপরাধকর্মে নিয়োজিত। এটিএম কার্ড জালিয়াতির সাথে বিদেশীদের জড়িত থাকার বিষয় সম্প্রতি স্পষ্ট হয়েছে। এছাড়া মানবপাচার, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা, চোরাচালান, হুন্ডি কারবার ইত্যাদি অপরাধে বিদেশীদের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা মোটেই নতুন নয়। সন্ত্রাস ও নাশকতামূলক ঘটনার সঙ্গে তাদের কারো কারো সংশ্লিষ্টতা থাকাও অসম্ভব নয়। বৈধভাবে যারা এখানে কাজ করছে, তাদের ব্যাপারে বলার তেমন কিছু নেই। বিশেষজ্ঞ জনশক্তি আমদানি সব দেশেই হয়। আমাদের দেশেও হতে পারে। তবে তার সংখ্যা যতটা সম্ভব কম হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে একটা নীতিমালা অনুসরণ করা উচিত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ তৈরি করা এক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে। দক্ষ-বিশেষজ্ঞ জনশক্তি আমাদের দেশেও তৈরি হচ্ছে। অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, গার্মেন্টে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে থাকলেও এ খাতে কর্মী-বিশেষজ্ঞ আমদানি করা হয়েছে, কিংবা বিদেশীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায়। প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে কি প্রডাকশন ম্যানেজার, মার্চেন্ডাইজার, সেলাই অপারেটর, কাটিং মাস্টার, ডিজাইনার, ওয়াশিং এক্সপার্টের অভাব রয়েছে?
গার্মেন্টে বিদেশীদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে অনেক বেশি। সিপিডির ২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন খাতে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় কাজ করছে। ওই বছর তারা তাদের দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়েছে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ভারতের পঞ্চম রেমিটেন্স প্রদানকারী দেশ। লক্ষ্য করার বিষয়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ যেখানে ভারতীয় প্রভাব হ্রাস করার জন্য ভারত থেকে শ্রমিক-কর্মী আমদানি কমিয়ে দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে ভারতীয়দের কর্মসংস্থান ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে ভারতের আগ্রহ ও ভূমিকার কথা কারো অজানা নয়। অর্থনীতি দখল করার চেষ্টাও অব্যাহত আছে। পণ্যের বাজার তো অনেক আগেই ভারতের দখলে চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত কর্মসংস্থানের বাজারটিও ভারত ধীরে ধীরে কব্জা করে নিচ্ছে। সর্বক্ষেত্রে এরকম ভারতীয় একাধিপত্য বিস্তার বা ভারতের ওপর একচ্ছত্র নির্ভরতা কোনো বিবেচনাতেই সমর্থনযোগ্য-গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সরকার ও নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়টি কেন খেয়াল করছে না বা আমলে নিচ্ছে না, সেটা একটি বড় প্রশ্ন। বিদেশীদের অবস্থান, সংখ্যা, কাজকর্ম এবং তারা কোথায় কী কাজ করছে, এই সামগ্রিক বিষয় খতিয়ে দেখা, নজরদারির মধ্যে আনা অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে সংসদে আলোচনা হওয়া দরকার। জনগণকে অবহিত করা দরকার। অবৈধভাবে যারা এখানে কাজ করছে তাদের তালিকা করে স্বদেশে ফেরত পাঠানোর বিকল্প নেই। দুষ্কর্ম, দুষ্কৃতি ও অপরাধের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করাও অপরিহার্য।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন