শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ও দখলবাজি বন্ধ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩০ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় অবৈধভাবে পাহাড় দখল করে বসতি গড়ে তুলেছে প্রভাবশালীরা। প্রথমে পাহাড় কেটে পাথর ও মাটি বিক্রি করে জায়গা তৈরী করা হয়, অত:পর সেখানে সুরম্য বাড়ি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার অথবা অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া হয়। প্রায় প্রতি বর্ষায়ই এসব পাহাড় ভূমিধসের শিকার হয়। কখনো কখনো ভূমিধসের কারণে বড় ধরনের প্রাণহানি ও মানবিক বিপর্যয় ঘটতে দেখা যায়। ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল। এরপর থেকে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধে নানা বাগাড়ম্বর শোনা গেলেও তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। ২০১৫ সালেও জুলাই মাসের একরাতে চট্টগ্রামের লালখান বাজারে পোড়া কলোনি ও আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে ও মাটি চাপা পড়ে দুই পরিবারের শিশুসন্তানসহ অন্তত ৬ জন নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়েছিল। পাহাড় কেটে পরিবেশ বিপর্যয় এবং ভূমিধসের মত মৃত্যুঝুঁকি সৃষ্টির বিপজ্জনক ফলাফল প্রত্যক্ষ করার পরও স্থানীয় প্রশাসনের চোখের সামনেই চলছে পাহাড় কাটাও দখলবাজি। পাহাড় কাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বিভিন্ন সময়ে আদালত চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার ও বান্দরবানের স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশনা জারি করলেও অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। এমনকি যে সিটি কর্পোরেশনের নগরীর পরিবেশগত সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করার কথা, সে-ই আইনগত বিধিবিধান উপেক্ষা এবং আদালতের নির্দেশনা অমান্য করছে। গত জানুয়ারী মাসে চট্টগ্রামের টাইগার হিলে চসিক মেয়র ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধে রুল জারি করে হাইকোর্ট।
বর্ষা সমাগত। সাংবাৎসরিক পাহাড় ধসে প্রাণহানির ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনবসতিতে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, চট্টগ্রামে লালখান বাজার এলাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত বাসিন্দাদের অন্যত্র সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন। লালখান বাজারের মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে শতাধিক পরিবারকে সেখানকার বসতি ত্যাগ করার নির্দেশ দানের পাশাপাশি শতাধিক ঘরের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যেখানে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম-কক্সবাজারেই লক্ষাধিক মানুষ অবৈধভাবে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে, সেখানে লোক দেখানো নোটিশ ও কিছু বাড়িঘরের ইউটিলিটি সার্ভিস বিচ্ছিন্ন করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রভাবশালী মহলের পাহাড় কাটা, পাহাড় দখলসহ পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কর্মকাÐ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যেখানে গ্যাস ও বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে চট্টগ্রামের নতুন আবাসিক ভবনগুলোতে এবং শিল্প-কারখানায় দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস-বিদ্যুতের নতুন সংযোগ বন্ধ রয়েছে সেখানে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনাগুলোতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ পেতে কোন অসুবিধা হয়নি।
প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা ও আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন ও ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি রোধে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। পাহাড় ধসে ২০০৭ সালে একসাথে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর গঠিত তদন্ত কমিটি পাহাড় ধসের ২৮টি কারণ এবং তা প্রতিরোধে ৩৬টি সুপারিশ উপস্থাপন করেছিল। পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, পাহাড় সংরক্ষণে নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণ, বালি উত্তোলন বন্ধ, পাহাড়ের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নির্মাণ এবং ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্পের অনুমোদন না দেয়ার সুপারিশ ছিল। সেই সাথে পাহাড়ে গড়ে ওঠা বসতি উচ্ছেদের পাশাপাশি বসবাসকারীদের পুনর্বাসনেরও সুপারিশ করা হয়েছিল। গত ১০ বছরেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ সময়েও পাহাড় ধসে আরো অনেক পরিবার তাদের স্বজন ও সর্বস্ব হারিয়েছে। এছাড়া প্রভাবশালী মহলের পাহাড় কাটার কারণে চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার ও বান্দরবনের মত মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমÐিত জনপদগুলোর অনেক এলাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। পাহাড়, জলাভূমি, বনভূমি, নদ-নদী ও ফসলি জমি সংরক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সীমাহীন ব্যর্থতা ও অমনোযোগিতা পুরো দেশকেই এখন পরিবেশগত বিপর্যয় ও বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে পাহাড়, সমতল, নদী ও বনভূমি দখলবাজি, ভূমিদস্যুতা ও দূষণের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির ত্বরিত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড়ে বসতি উচ্ছেদের সাথে সাথে পাহাড় কাটা ও দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন