দেশে যখন জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসের হুমকিসহ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তখন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সিটি নির্বাচন হলেও এটি ছিল বহুল আলোচিত ও নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি অগ্নি পরীক্ষার নির্বাচন। এই পরীক্ষায় নির্বাচন কমিশন কোন রকমে উৎরে গেলেও শতভাগ সফল এটা বলা যাচ্ছে না। যদিও নির্বাচন কমিশন শতভাগ সফল এবং জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বলে দাবী করেছে। তার এই দাবী পুরোপুরি মেনে নেয়া যায় না, সঙ্গতও নয়। কারণ, বিগত নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত শেষ নির্বাচন হিসেবে নাসিক নির্বাচন যতটা সুষ্ঠু, অবাধ ও ত্রুটিমুক্ত ছিল নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত কুসিক নির্বাচন ততটা সুষ্ঠু ও ত্রুটিমুক্ত হয়নি। এই নির্বাচনেও ব্যালট ছিনতাই, বিএনপি’র এজেন্টদের বের করে দেয়া, প্রকাশ্য নৌকায় সিল মারার ঘটনাবলী গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। মাত্র দুই লাখ ভোটারের একটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রতি সারাদেশের সকল রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতি সচেতন মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। আজ থেকে অনুষ্ঠিত ৫ দিনের আইপিইউ সম্মেলন উপলক্ষে কয়েকদিন আগে থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাই প্রোফাইল সরকারী ও পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিরা ঢাকায় উপস্থিত রয়েছেন। বিষয়টি তাদেরও নজরে ছিল। বিগত সংসদ নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় বাংলাদেশের নির্বাচন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর যখন বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নজর রাখছিলেন তখন নির্বাচনটি শতভাগ অবাধ, সুষ্ঠু, ত্রুটিমুক্ত রাখা জাতীয় স্বার্থে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের অনেক বড় দায়িত্ব ছিল।
দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নৌকা ও ধানের শীষ দলীয় প্রতীকে এই নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু না হলেও বিরোধীদল এবং পর্যবেক্ষক মহলের পক্ষ থেকে কিছু বাস্তব অভিযোগ থাকা সত্তে¡ও নির্বাচনের ফলাফল সকলেই মেনে নিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যা’ নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, যে নির্বাচনকে নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক বিতর্ক ও আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের অনুঘটক বলে মনে করা হয়েছিল, সে সব বিবেচনা মাথায় রেখেও এ নির্বাচনে নাসিক নির্বাচনের মত আরেকটি শতভাগ সফল নির্বাচনের দৃষ্টান্তই ছিল সকলের কাম্য। বেশ কয়েকটি ভোট কেন্দ্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের জিম্মি করে ব্যালট পেপার নিয়ে নৌকায় সিল মারা, প্রকাশ্যে সিল মারতে ভোটারদের বাধ্য করা, বোমাবাজি হট্টগোল করে ত্রাস সৃষ্টি করা, বিএনপি’র এজেন্টদের বের করে দেয়ার মত ঘটনা প্রত্যক্ষভাবে ঘটলেও নির্বাচন কমিশন দুটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দেয়া ছাড়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে কোন আইনগত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। বেশীরভাগ কেন্দ্রে নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে সচেষ্ট ও সফল হলেও একটা প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ নির্বাচনে স্বল্প সংখ্যক ভোট কেন্দ্রে কোন পক্ষকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হলে নির্বাচনের ফলাফল যথেষ্ট প্রভাবিত হতে বাধ্য। এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা না ঘটলে বিএনপি প্রার্থী আরো বড় ব্যবধানে বিজয়ী হতে পারতেন বলে সংশ্লিষ্টরা দাবী করছেন।
বিগত নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থায় যে একপাক্ষিক দখলবাজি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তা থেকে জাতি এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর গণআস্থা এখনো আসেনি। সাম্প্রতিক সময়ের স্থানীয় ও উপনির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতির নিম্নহার থেকে তা অনেকটা স্পষ্ট। প্রশ্নবিদ্ধ ও অংশগ্রহণহীন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বিগত নির্বাচন কমিশন দেশে যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিএনপিসহ সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের সক্ষমতার জানান দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জনই নতুন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও লক্ষ্য। কুসিক নির্বাচনে সে লক্ষ্য অর্জনে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। যদিও শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের পক্ষে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের গ্যারান্টি দেয়া সম্ভব নয়। নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা ও সব রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্তে¡ও কুসিক নির্বাচন প্রতিদ্ব›দ্বী দলগুলো মেনে নিয়েছে। আওয়ামী লীগ তার পরাজয় মেনে নিয়েছে। এটি একটি ভালো দৃষ্টান্ত। সব মিলে নির্বাচন কমিশন স্বস্তি বোধ করতে পারে। এই নির্বাচনের আয়নায় আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য করণীয় সম্পর্কে নতুন নির্বাচন কমিশন নিজের অবস্থান মূল্যায়নে সক্ষম হবে বলে আমরা আশা করি। দেশে একটি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদ্যমান রয়েছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল আগামীতে সকলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ অব্যাহত রেখেছে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট ডি ওয়াটকিন্স সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে বৈঠক শেষে বলেছেন, জাতিসংঘ আগামীতে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চায় বলেও তিনি জানিয়েছেন। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকার যেমনই হোক, নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ ও সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা, সামর্থ্যের প্রতিফলন থাকতে হবে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে নির্বাচন কমিশনসহ সকল স্টেকহোল্ডারের অনেক শিক্ষণীয় রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন