রাজধানী ঢাকার যানজটসহ নানাবিধ নাগরিক সমস্যা, পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা নগরীকে আধুনিক বাস্তুব্যবস্থাপনা ও নগর পরিকল্পনার আওতায় গড়ে তুলতে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতার পর অল্প সময়ে ঢাকার জনসংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়ে অনেক সমস্যা জট পাকিয়ে যাওয়ার পর ১৯৯২ সালে সরকার কর্তৃক গৃহীত মহাপরিকল্পনার আওতায় প্রথমে ১৯৯৫ সালে ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) গ্রহণ করা হয়। অতঃপর ১৯৯৬ সালে ঢাকার জন্য একটি ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই ড্যাপ’র গেজেট প্রকাশ করতেই ২০১০ সাল পর্যন্ত সময় ব্যয় করা হয়। অতঃপর ড্যাপ বাস্তবায়নে শুরু হয় নানা টালবাহানা। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ড্যাপ বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি অব্যাহত চাপ থাকলেও মূলত কথিত ভূমিদস্যু ও আইন লঙ্ঘন করে গড়ে তোলা বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের প্রভাবশালী মালিকদের কারণে ড্যাপ বাস্তবায়ন শুরু থেকেই বাধার সম্মুখীন হয়। ড্যাপ বাস্তবায়নের প্রথম সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের পরিবর্তন ও নতুন ড্যাপ প্রণয়নের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টরা শীঘ্রই ড্যাপ বাস্তবায়ন শুরু হবে বলে কিছুদিন পর পর প্রতিশ্রæতি দিচ্ছেন।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)’র আর্থিক সহযোগিতায় ২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া ২০ বছর মেয়াদী (২০১৬-২০৩৫) রিভাইজড ঢাকা স্ট্রাকচারাল প্লান চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে ড্যাপ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তদারকির দায়িত্ব মূলত রাজউকের উপর বর্তালেও ড্যাপ ও বাস্তু আইনের বিধিমালা লঙ্ঘন করে রাজউক নিজেই অবৈধভাবে আবাসন ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছে। রাজউকের অবৈধ আবাসন ব্যবসায় জড়িত হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জলাধার আইন লঙ্ঘন করে ফ্লাড ফ্লো জোনে মাটি ভরাট করে বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানীর নতুন নতুন আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার সুযোগ পাচ্ছে। নিম্নভূমিতে এবং ফসলি জমিতে নতুন আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার বিরুদ্ধে রাজউক কোন উদ্যোগ না নিয়ে নিজেরাই একের পর এক এ ধরনের আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করছে। মূলত রাজউকের আইন লঙ্ঘন এবং ড্যাপ বাস্তবায়নে সদিচ্ছার অভাবেই ড্যাপ অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ড্যাপ নকশায় বিশেষভাবে সংরক্ষিত নিম্নাঞ্চল বা কনজারভেশন এরিয়াতে রাজউকের পূর্বাচল, ঝিলমিলের আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় কেরানীগঞ্জে ড্যাপ নির্দেশিত সংরক্ষিত এলাকায় সংসদ সদস্যদের জন্য ২,২৯০ একরের বিশালায়তন আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে।
গতকাল প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ঢাকার কেরানিগঞ্জের আটিবাজার এলাকায় রাজউকের প্রস্তাবিত একটি আবাসন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে স্থানীয় হাজার হাজার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। গত সোমবার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আগত হাজার হাজার নারী-পুরুষ ব্যানার-ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাজউকের ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মানব বন্ধনে অংশগ্রহণ করেছে। মূলত সংসদ সদস্যদের আবাসনের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত ‘কেরানিগঞ্জ মডেল টাউন’র জন্য কোন বাড়িঘর অধিগ্রহণ করা হবে না বলে রাজউকের পক্ষ থেকে বলা হলেও এই প্রকল্পের জন্য তিনটি ইউনিয়নের ১৬টি মৌজার অন্তর্গত ২ হাজার ২৯০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এসব জমি ড্যাপ-এ সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা এখন ফসলি জমি এবং ফ্লাড ফ্লো জোন হিসেবেই চিহ্নিত। গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে রাজউকের এমন যথেচ্ছ আইন লঙ্ঘনকেই ড্যাপ অকার্যকর হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইতোপূর্বেও বিভিন্ন সময়ে রাজউক কর্তৃক আবাসন ব্যবসায় এবং এ লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণকে ঢাকায় পরিবেশ বান্ধব ও সুপরিকল্পিত নগরায়নের অন্যতম অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পরিবেশবান্ধব, আধুনিক ও বাসোপযোগী ঢাকা গড়ে তুলতে রাজউকের দায়-দায়িত্ব ও কর্মপরিধি সীমাবদ্ধ করার পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবীও দীর্ঘদিনের। কয়েক বছর আগে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এ লক্ষ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরেছিল। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উন্নয়ন মনিটরিং ছাড়া রাজউককে বাড়তি ক্ষমতা না দেয়া, পরিকল্পনাবিদ নগরতত্ত¡বিদদেরকে নিয়ে রাজউকের পর্ষদ ঢেলে সাজানো, বেসরকারী আবাসনের ক্রেতাদের স্বার্থ সংরক্ষণে রাজউকের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন, বেআইনী আবাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, শত বছরের উন্নয়ন ও ডেমোগ্রাফিক চিন্তা মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণের মত বিষয়গুলো অগ্রাহ্য করার কোন সুযোগ নেই। ড্যাপ বাস্তবায়নে অহেতুক কালক্ষেপণ এবং অবৈধ আবাসন প্রকল্পের অবাধ বিস্তার অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন