দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান খাত গার্মেন্টসে এখন কালো মেঘের ছায়া পড়েছে। চিন্তিত হয়ে উঠতে শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট শিল্পের মালিকরা। দেশের প্রধান এই শিল্পখাতটির বর্তমান জটিল সমীকরণ মেলাতে নেতৃবৃন্দের মাঝে ভর করেছে হতাশা ও ক্ষোভ। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে নতুন সম্ভাবনা নেই বলে দৈনিক ইনকিলাবের সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন বিজিএমইএ’র সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান। প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছর ধরে যেখানে বিজিএমইএ নেতারা মনে করতেন ২০২১ সালের মধ্যে বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করবে বাংলাদেশ, সেখানে এখন বিজিএমইএ নেতাদের কণ্ঠে ভাসছে হতাশা। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তারা বলেছেন, রানা প্লাজা ধসের পর সংস্কার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন কারণে প্রায় দেড় হাজার পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া পোশাক রপ্তানিতে আগামী তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে ভারত। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সংগঠনটির সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট মো. ফারুখ হাসান মনে করেন, দেশীয় মুদ্রার মান শক্তিশালী থাকায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এখন পোশাকের দাম কমে যাওয়ায় বেচাকেনাও কমে গেছে। ব্যাংকের সুদের হার বেশি থাকায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। সে কারণে খাতকে টিকিয়ে রাখতে বাড়তি প্রণোদনার ব্যবস্থা করার পক্ষে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সংগঠনটির সভাপতিও মনে করেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের দেশে এ খাতের উন্নয়নের জন্য আলাদাভাবে পরিকল্পনা নেয়া এখন সময়ের জোর দাবি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী অর্থবছরের প্রথম আট মাসে তৈরি পোশাক খাত রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮২ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবে যেখানে পোশাক খাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ ধরা হয় সেখানে কেবল ফেব্রæয়ারিতেই ৬ শতাংশ কমে গেছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান বলেছেন, এই পরিস্থিতির জন্য বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়া, প্রত্যাশা অনুযায়ী চীনের সাবেক ক্রেতাদের দেশে আনতে না পারা, ডলারের বিপরীতে টাকার শক্তিশালী অবস্থান, ডলারের বিপরীতে ইউরোর দুর্বল হওয়া এবং কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ব্যর্থ হয়ে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়া দায়ী। বিদ্যমান পরিস্থিতি এতটাই জটিল আকার ধারণ করেছে যে, তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে আশার বাণী শোনাতে পারেনি গবেষকরাও। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নিম্ন পর্যায়েই যেভাবে ওঠানামা করছে তাতে চলতি অর্থবছরে তো বটেই, ভবিষ্যতের লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। সংকট নিরসনে তিনি মনে করেন, রপ্তানি বাজারের সমস্যা নিরূপণে সরকারকে শিল্প-উদ্যোক্তা, বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে দ্রæত ব্যবস্থা নিতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বকোটা ব্যবস্থার আওতায় বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে উদ্যোক্তারা নিজেদের কলাকৌশলে শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে এবং দেশের অর্থনীতিতে আশার চেয়েও বেশি সংযুক্ত করেছে। মূলত ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ভারতীয় সমর্থনকে কেন্দ্র করেই দেশের গার্মেন্টস শিল্পের উপর কালো মেঘের ছায়া পড়তে শুরু করে। এই শিল্পের সাথে আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা-বিশ্বাসের যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, সেকথাও বহুবার বহুভাবে বলা হয়েছে। দেশের মিডিয়াও অনেকদিন থেকে এক ধরনের অশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণভাবে যেমনি এক ধরনের ভারতীয়করণ করার অপচেষ্টা হয়েছে, তেমনি ভারতের বাজেটেও এই খাতকে সহায়তাদানে হাত প্রসারিত করা হয়েছে। এদিকে আমাদের অর্থমন্ত্রী কেবল পথ খুঁজছেন কীভাবে ট্যাক্স ও করের বোঝা বাড়ানো যায় তা নিয়ে। মাত্র সেদিনও তিনি বলেছেন, কম সুদের কথা তিনি ভাবতেও পারেন না। সুতরাং এই খাতে সংকট যে সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তা মূলত নতুন কিছু নয় এবং একে হঠাৎ আসা কোন ঝড়ও বলা যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভারসিটির প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, গত সাড়ে তিন দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত চারটি বড় বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে। দুর্যোগ আর ঝুঁকির মধ্যদিয়েই খাতটি সমৃদ্ধি লাভ করেছে। তিনি মনে করেন, ঝুঁকির মধ্যেই তৈরি পোশাক খাত আরো বাড়বে। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শিল্পব্যবসার বিকাশের সুযোগ খুব কম। জাতীয় সমৃদ্ধির বিবেচনা থেকেই সরকার নানা ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকে। মূলত ব্যাপারটি হচ্ছে উদ্যোক্তাকে সহায়তার অর্থ হচ্ছে অর্থনীতিকে সুসংহত করা। এক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম হবার নয়। এ খাতের অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে বা দাঁড়াতে যাচ্ছে তাতে আর এক মুহূর্তও দর্শকের ভূমিকায় থাকার সুযোগ নেই। প্রতিবেশী দেশগুলো কী করছে তার নিরিখে সংশ্লিষ্ট সকলে মিলে খাতকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করণীয় তার সবটুকু করাই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা অর্জনের উপরও গুরুত্ব দিতে হবে। সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা থাকলে সংকট মোকাবিলা করা কোন কঠিন বিষয় নয়। অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ খাত রক্ষায় দ্রæতব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন