সিটি কর্পোরেশন ও পৌর এলাকার শহরাঞ্চল বাদ দিয়ে সারাদেশে ৪ হাজার ২৭৯৮টি ইউনিয়ন পরিষদে ২২ মার্চ থেকে পর্যায়ক্রমে শুরু হতে যাচ্ছে নির্বাচন। প্রথম ধাপের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন আজ। এছাড়া দ্বিতীয় মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ও শেষ হচ্ছে আজ। তফসিল অনুযায়ী প্রথম ধাপে ৭৩৮ ইউপিতে ভোট গ্রহণ ২২ মার্চ। এ ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র দাখিল শেষ হয়েছে ২ ফেব্রুয়ারি। প্রথম ধাপের প্রতীক বরাদ্দ হবে ৩ মার্চ। দ্বিতীয় ধাপে ৬৭২ ইউপিতে ভোট গ্রহণ হবে আগামী ৩১ মার্চ। ইতোমধ্যেই এ নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা স্থান করে নিয়েছে। বলা হচ্ছে, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থীদের অংশগ্রহণের আগ্রহ কমেছে। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। অন্যদিকে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে শঙ্কাও প্রার্থী কমে যাওয়ার কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি। চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মামলার আসামিরাও রয়েছে। স্কুলের গ-ি পার হননি এমন প্রার্থীরাও রয়েছেন। এদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিজেদের স্বাধীন সত্তাকে ভুলে গিয়ে সরকারের (নির্বাহী বিভাগ) ইচ্ছা পালন করছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। স্থানীয় নির্বাচন বিশেষজ্ঞ সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণে ভোটের আগেই যে হানাহানি শুরু হয়েছে তা ক্রমান্বয়ে বাড়বে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ইউপি নির্বাচনকে সামনে রেখে সীমান্তপথে আসছে অস্ত্র, বাড়ছে হত্যাকা-।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও নির্বাচনটি তৃণমূল পর্যায়ে হওয়ার কারণে এর প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। এ নির্বাচন নিয়ে সাধারণের আগ্রহের কোনো কমতি কোনো কালেও ছিল না। অতীতে দলীয় ভিত্তিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলেও একেবারেই যে নির্দলীয় ছিল, তাও যেমনি সত্যি নয়, তেমনি মারাত্মক রকমের দলীয় হতো, তাও সঠিক নয়। এর নানাবিধ কারণ রয়েছে। সাধারণভাবে এলাকার উন্নয়ন, ব্যক্তিত্ব, প্রভাব Ñ এসবই বিবেচনায় নেয়া হতো। এবারে প্রথম বারের মতো রাজনৈতিকভাবে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিধায় মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা নেয়া হয়েছে। এর ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে। নির্বাচন যদি নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারত তা হলে হয়ত বলা যেত, বাস্তব পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। এখন তো অবস্থা এই যে সরকারবিরোধী মনোনয়ন প্রার্থীদের অনেককেই দৌড়ের ওপর রাখা হয়েছে। অনেক এলাকায় প্রার্থীরা দাঁড়াতেই সাহস পাননি। বিরোধী প্রার্থীর বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। অনেকের স্ত্রী, পুত্র, কন্যাও নিরাপদ নন। অনেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেক জায়গায় মনোনয়নপত্র জমা দিতেও দেয়া হয়নি। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য ক্ষমতাসীনদের চাপের মুখে আছেন বিএনপির কিছু প্রার্থী। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও এ চাপ মোকাবিলা করছেন। নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা অভিনব কৌশল অবলম্বন করছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় এক দফা বাধার পর আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও বিএনপি প্রার্থীদের অনেকেই এখন নতুন ধরনের চাপে রয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এসব লাঘবে যে নির্বাচন কমিশনের জোরদার ভূমিকা পালনের কথা ছিল, তারা মূলত এসব আমলে নিচ্ছে বলে মনে হওয়ার কোনো আলামত নেই। মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধা, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য প্রার্থীকে হুমকি, আইনÑশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব ও মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করার বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হলেও ইসির সচিব বলেছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওই অভিযোগে কার বিরুদ্ধে, কখন ও কী অপরাধে, তা উল্লেখ করতে হবে। তিনি দাবি করছেন, এখন পর্যন্ত ইসি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পায়নি। কার্যত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব যে নির্বাচন কমিশনের, তাদের দায়িত্বশীলদের থেকে এ ধরনের বক্তব্য শোনার পর মূলতই এটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই যে, নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে। অভিযোগ শোনার পর যেখানে অভিযুক্তদের শনাক্তকরণে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কথা, তার পরিবর্তে তাদের কথায় নির্বাচন ভ-ুলকারীরা যে আরো উৎসাহিত হবে, সে ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই। এসব কারণেই নির্বাচন যে প্রহসনে পরিণত হতে পারে সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা জাতীয় এবং স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, অতীতে ছোটখাটো সংঘর্ষ ছাড়া এ ধরনের নির্বাচনে কখনো বড় ধরনের কোনো বিপত্তি হয়নি। সম্ভবত রাজনৈতিক ব্যানারে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিধায় এবারেই জাতীয় নির্বাচনের তিক্ত বিষয়গুলোর অবতারণা হতে যাচ্ছে। অগ্রহণযোগ্য প্রবণতার বিস্তৃতি ঘটতে যাচ্ছে তৃণমূল পর্যন্ত। এর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে গ্রামেগঞ্জে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিই নন, তারা কার্যত গ্রামগঞ্জে সালিশও করেন। স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ মেটাতে তাদের আন্তরিকতার কোনো জুড়ি নেই। এবারে অধিকাংশ প্রার্থী ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে সেক্ষেত্রে ভিন্নতর সমস্যার গন্ধ রয়েছে। যাই হোক, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে হয়ত অন্য কোনো প্রশ্নের জন্ম হতো না। এখন তো মনে হচ্ছে, দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে অথবা নিরঙ্কুশ বিজয় দেখাতে যেন-তেন একটি নির্বাচন কিংবা নির্বাচন-নির্বাচন খেলা অনুষ্ঠান ও মনের মতো ফল ঘোষণা কেবল সময়ের অপেক্ষামাত্র। যার ফলে মানুষকে মন্তব্য করতে শোনা যাচ্ছে, এতকিছু না করে একসাথে ফল ঘোষণা করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন