চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আজ শুক্রবার ৭ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাচ্ছেন। তার এই সফরকালে তিনি ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ভাইস প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করবেন। এই সফরকালে তিনি বাইরে কোনো হোটেলে থাকবেন না। তাকে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে রাখা হবে। এটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি বিরল সম্মান। এই সম্মান খুব কম রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানকে দেওয়া হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর তথ্য মোতাবেক, এই সফরকালে ৩৩টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পূর্বেই যে বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বইছে সেগুলো হলো, একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি অথবা সমঝোতা স্মারক। আর একটি হলো চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার এবং সেখান থেকে মালামাল পরিবহনের জন্য ট্রানজিট চুক্তি। আরেকটি বিষয়ের দিকে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। সেটি হলো, তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি। সরকারী ভাষ্য মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা হবে তখন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঐ আলাপ আলোচনায় উপস্থিত থাকবেন। তবে সরকারী সূত্রে উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, এই যাত্রায় তিস্তা চুক্তি হবে না। সেটি নাকি পরে কোনো এক সময়ে হবে। বাংলাদেশ সরকার, মিডিয়া এবং এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বলে আসছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন কোন বিষয়ে চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে সেই ব্যাপারে বেশ কয়েকদিন থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি চলছে। এইগুলোর মধ্যে কানেকটিভিটি, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সব বিষয়কে ছাপিয়ে যে দুটি বিষয় বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে সেই দুটি হলো প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক এবং বন্দর ব্যবহার ও মালামাল পরিবহনে ট্রানজিট সুবিধা।
প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা চুক্তি বা স্মারক নিয়ে বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত মহল সরব হয়েছে। একটি অভিন্ন মতামত প্রায় সকলেই প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশে প্রায় চার ধারেই ভারত। শুধুমাত্র দক্ষিণপূর্বে সামান্য অংশে রয়েছে মিয়ানমার। ভারতের সাথে রয়েছে আমাদের সর্বোচ্চ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এমন একটি ভৌগলিক অবস্থান এবং ঘনিষ্ঠতম সম্পর্কের পটভূমিকায় ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি বা স্মারকের প্রয়োজন হচ্ছে কেন সেটি কারো কাছেই বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন করার মত কোনো নিকট বা দূরের প্রতিবেশী নাই। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক এমনিতেই স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী ভালো। প্রশিক্ষণ, সফর বিনিময় এমনকি জঙ্গি দমনসহ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যৌথ টহল তো চলছেই। সেখানে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চুক্তি বা স্মারকের প্রয়োজন হচ্ছে কেন? একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র এবং কর্তৃপক্ষীয় মহল থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অন্য কথায় এই ব্যাপারে বাংলাদেশের তেমন কোনো গরজ নেই। ভারতের সক্রিয় উদ্যোগেই প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে চুক্তি বা স্মারক সই হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ গরজটি ভারতের। তাই এক শ্রেণীর রাজনীতি নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মনে করেন যে, এই চুক্তি বা স্মারকের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ভারত ৫০০ মিলিয়ন ডলার বা ৫০ কোটি ডলার সাহায্যের একটি চুক্তি হবে। সেই চুক্তি মোতাবেক, ভারত বাংলাদেশের কাছে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করবে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, ভারত নিজেই অস্ত্র আমদানিকারক একটি দেশ। সেই দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয়ের কোনো যৌক্তিকতা প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকগণ খুঁজে পান না। সরকারি ঘরানার কূটনীতিক বলে পরিচিত সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হুমায়ুন কবির বলেন, এই ধরনের চুক্তির আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি না। তিনি মনে করেন, সামরিক চুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজন কতটুকু সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, এই ধরনের চুক্তি হতে হবে খোলাখুলিভাবে, সবাইকে জানিয়ে। সাধারণ মানুষকে এই ধরনের চুক্তির সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে। অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী মেজর হাফিজ উদ্দীন প্রশ্ন করেছেন, পাকিস্তানকে তাড়িয়ে দিয়ে কি এখন দিল্লির দাসত্ব করার জন্য আমরা মুখোমুখি হলাম? তিনি বলেন, একাত্তরে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছে। এই জন্য তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু সেই জন্য কি তাদের ঋণ আমাদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত শোধ করতে হবে?
দুইটি সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের প্রশ্নটিও বাংলাদেশের জনমতকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। এই দুটি বন্দর বাংলাদেশের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। সেখানে ভারতের মত বিশাল দেশকে সেই দুটি বন্দর ব্যবহার করতে দিলে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আমদানি রফতানি মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হবে বলে ব্যবসায়ী মহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তার ওপরে ভারত তার জন্য বন্দরে আলাদা শেড ইয়ার্ড চায়। সেটি করলে আমাদের স্পেস কতটুকু থাকবে সেটি চিন্তা করে দেখতে হবে। বন্দর ব্যবহার সংক্রান্ত চুক্তির যে খসড়া প্রকাশিত হয়েছে সেখান থেকে জানা যায় যে, ভারত বিনা মাশুলে বন্দর ব্যবহার করতে চায়। বিশেষ করে বন্দর থেকে মালামাল পরিবহনের জন্য যে ট্রানজিট সুবিধা তারা চাচ্ছে তার বিপরীতে তারা কোনো মাশুল দেবে না। এতে স্পষ্টভাবে বলতে হয় যে, ভারতের এই সুবিধা দিয়ে চুক্তি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারত সফরকালে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে না। জনগণ প্রধানমন্ত্রীর কথায় আস্থা রাখতে চায়। তবে স্বাভাবিকভাবে সকলের মুখে যে প্রশ্নটি উচ্চারিত হচ্ছে সেটি হলো, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের ফলে আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশ কি পাচ্ছে? অতীতেও বাংলাদেশ ভারতকে মুক্ত হস্তে অনেক কিছুই দিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কি পাচ্ছি? এ পর্যন্ত বাংলাদেশ যতকিছু দিয়েছে তারমধ্যে বাংলাদেশের কয়েকটি রফতানি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার ছাড়া ভারত আর কিছুই দেয়নি। এবারও ৩৩টি চুক্তি বা স্মারক সই হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের একমাত্র প্রাপ্তি ছিলো তিস্তার পানি। সেই চুক্তিটিও হচ্ছে না। সুতরাং সফর শেষে এসব হিসাব নিকাশ যে উঠে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। জনগণ আশা করে প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের সময় যা কিছুই হোক, সেখানে যেন বাংলাদেশের মানুষের মতামত এবং অনুভূতির প্রতিফলন ঘটে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন