যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার হোমস প্রদেশের আল-শায়রাত বিমান ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ভূমধ্যসাগরে অবস্থানকারী দু’টি যুদ্ধজাহাজ থেকে এই হামলা চালানো হয় গত শুক্রবার। হামলায় বিমান ঘাঁটিটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মারা গেছেন একজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাসহ ৬ জন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই হামলা চালানো হয়েছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি জানিয়েছেন, প্রয়োজনে আরো হামলা চালানো হতে পারে। সম্প্রতি সিরিয়ার সেনাবাহিনী সে দেশের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইদলিব প্রদেশের খান শেইখুন শহরে রাসায়নিক হামলা চালালে ২৭ জন শিশুসহ অন্তত ৭০ জনের মৃত্যু হয়। সিরিয়া সরকার এই হামলার দায় বিদ্রোহীদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করলেও আন্তর্জাতিকভাবে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। মূলত ওই রাসায়নিক হামলার একটি শক্ত জবাব দেয়ার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের তরফে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, জাতিসংঘ ব্যবস্থা না নিলে সিরিয়ায় সামরিক অভিযানে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার ও মানুষ হত্যার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানো হয়েছে। বলা বাহুল্য, প্রতিবাদ ও নিন্দাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন ছিল যথার্থ প্রতিকারের পদক্ষেপ নেয়া। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকেই এই হামলার পথে যেতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ব্রিটেন, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ফ্রান্স, সউদী আরব, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ। নিন্দা জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট আসাদের মিত্র রাশিয়া ও ইরান। চীনের তরফে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, আমরা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরোধিতা করি, এর উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন।
যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তা যৌক্তিক এবং ইতিবাচক বলাই সঙ্গত। নিষিদ্ধ ঘোষিত অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষ হত্যা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আসাদ সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে। এর কার্যকর জবাব দেয়া না গেলে অনুরূপ হামলা ও হত্যার ঘটনা সেখানে আরো ঘটতে পারে। অন্যান্য দেশেও এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এই হামলা চালিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, অনুরূপ হামলা ও হত্যাকান্ড কোথাও ঘটলে হামলাকারী ও ঘাতকশক্তি নিরাপদ থাকতে পারবে না। সিরিয়ার পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর অজানা নেই। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সে দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। এ যাবত সরকারি বাহিনীর পরিকল্পিত হত্যাকান্ড ও হামলায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিরোধীসহ কত মানুষ যে নিহত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সঙ্গতকারণেই সেখানে জনবিদ্রোহ হয়েছে। কিন্তু এই জনবিদ্রোহকে একটি ইতিবাচক ও যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যেতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রশাসন বা ওবামা প্রশাসনের দায় সবচেয়ে বেশি। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে হটাতে এবং সেখানে একটি রাজনৈতিক মীমাংসা নিশ্চিত করতে সউদী আরবসহ উপসাগরীয় দেশসমূহ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে দৃঢ় সমর্থন দিলেও ওবামা প্রশাসন কোনো কার্যকর সামরিক পদক্ষেপ নেয়নি, যার পরিণতিতে সিরিয়ার মতো একটি ঐতিহ্যবাহী ও গুরুত্বর্পূ দেশ কার্যত ছারখার হয়ে গেছে। সেখানে যুদ্ধ ও হানাহানি প্রলম্বিত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ দেশ ত্যাগে এবং পথে-ঘাটে প্রাণ হারাতে বাধ্য হয়েছে। এশিয়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সিরিয়ার নাগরিকদের দুঃখ-দুর্ভোগের কথা কারো অজানা নেই। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের প্রশাসন প্রশংসার যোগ্য এ কারণে যে, ওবামা প্রশাসনের রহস্যময় নীতি সে অবলম্বন করেনি। বিভিন্ন ঝুঁকির আশঙ্কা থাকলেও কঠোর সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করেনি। বস্তুত, সাবেক মার্কিন প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল শিয়া-সুন্নি বিরোধকে ইন্ধন যুগিয়ে স্থায়ী করা, সুন্নি রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙে দেয়া কিংবা অস্থিতিশীল করে তোলা, ইসরাইলকে সম্পূর্ণ নিরাপদ করা এবং এই যুদ্ধ-সংঘাতের মধ্য দিয়ে সম্পদ লুণ্ঠন ও অস্ত্র ব্যবসা জোরদার করা। যুক্তরাষ্ট্র চাইলে আগেই ইরাক সঙ্কট, সিরিয়া সঙ্কট, লিবিয়া সঙ্কটসহ অনান্য সঙ্কটের যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য সমাধান হয়ে যেত।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই হামলা চালানোর মাধ্যমে এই বার্তা বিশ্বকে দিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে চলছিল ঠিক সেভাবে চলবে না। অনেকের ধরাণা ছিল, রাশিয়ার সঙ্গে সখ্যের কারণে ট্রাম্প হয়তো মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেবেন, গুরুত্ব কমিয়ে আনবেন। অনেকের অভিমত এমনও ছিল, মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার খবরদারি ও কর্তৃত্ব বাড়বে। ট্রাম্প তার একক সিদ্ধান্তে সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে এই বিভ্রান্তি মোচন করেছেন। রাশিয়া ও ইরান এই হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ কেন জানিয়েছে তা বুঝতে কারোর অসুবিধা নেই। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া উত্থান ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য এর ফলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। লক্ষ্য করার বিষয়, সউদী আরব ও তুরস্কের মতো মার্কিন মিত্ররা আবার যুক্তরাষ্ট্রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্য মিত্রদের মধ্যেও আস্থা ফিরে এসেছে। তাদের সমর্থনই এর প্রমাণ বহন করে। অবশ্য এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দ্ব›দ্ব-সংঘাত জোরদার হলে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্কটগুলো কেটে যাবে। দুই পরাশক্তির আন্তরিক ইচ্ছা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ন্যায়সঙ্গত ভূমিকাই কেবল সঙ্কটগুলোর দ্রæত নিরসন সম্ভব করে তুলতে পারে। এ ব্যাপারে একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক উদ্যোগ ও পদক্ষেপ প্রয়োজন, যার লক্ষ্য হবে মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা। আমরা আশা করি, অতঃপর সেই প্রত্যাশিত রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন