বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় গত শনিবার তার ও তার ভারতীয় প্রতিপক্ষ নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউজে এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। বহুল আলোচিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতাবিষয়ক তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এছাড়া প্রতিরক্ষা ঋণ সহায়তাবিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ নিয়ে প্রতিরক্ষাবিষয়ক সমঝোতা স্মারকের সংখ্যা আসলে দাঁড়িয়েছে চারটি। এছাড়া আর যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তার মধ্যে মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, আণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, পরমাণু নিরাপত্তা, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিচারিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, নৌ-বিদ্যা ও ভূবিদ্যা বিষয়ে সহযোগিতা, গণমাধ্যম ক্ষেত্রে সহযোগিতা, বর্ডার হাট ট্রেন ও মোটরযান চলাচল ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চুক্তি ও সমঝোতাগুলোর শিরোনাম থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, এসব চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভারতনির্ভরতা কার্যত নিরঙ্কুশ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু এই আস্থার বিষয়টি অপরিবর্তনীয় নয়। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন এটা সত্য, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সমান সত্য। নানা চুক্তি ও সমঝোতার জালে জড়িয়ে এই যে বাংলাদেশকে ভারতনির্ভর করে তোলা হলো, এর নিগড় থেকে বাংলাদেশের বেরিয়ে আসা মোটেই সহজ হবে না। সরকার পরিবর্তন হলে পারস্পরিক আস্থা এখন যেমন আছে, তেমন নাও থাকতে পারে। কিন্তু চুক্তি ও সমঝোতাগুলো থাকবে; তা ছেঁটে ফেলে দেয়া যাবে না।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি বা সমঝোতা নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। আলোচনার সারসংক্ষেপে এ রকম : এ ধরনের চুক্তি বা সমঝোতার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। প্রথমত, তা বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত নীতি ও ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সামরিক ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতাই যথেষ্ট। একে চুক্তি বা সমঝোতার কাঠামোর মধ্যে এনে সম্প্রসারিত করা বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল নয়। দ্বিতীয়ত, ভারত যখন বন্ধু, তখন তার সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার দরকার কি! যে কোনো দেশের প্রতিরক্ষা নীতি ও কৌশল নির্ধারিত হয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতার ওপর আঘাত আসতে পারে কোন দেশ বা দিক থেকে তার নিরিখে। সে অনুযায়ীই প্রতিরক্ষা নীতি-কৌশল নির্ধারণ ও সামরিক বাহিনীকে সাজানো হয়, অস্ত্র-সরঞ্জাম সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মোডিভেশনটাও এ বিবেচনা থেকেই সম্পাদিত হয়। আমরা জানি, বাংলাদেশের প্রায় তিন দিকেই ভারত। জাতীয় প্রতিরক্ষার ওপর, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতার ওপর আঘাত কোন দিক থেকে আসতে পারে তা অনুমান করা মোটেই অসম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন কিংবা কোনো দূর দেশ এমনকি প্রতিবেশী মিয়ানমারও আমাদের জন্য কোনো হুমকি নয়। বাস্তবতার এই প্রেক্ষাপটে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষাসহযোগিতা চুক্তি বা সমঝোতা হলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটিই উন্মোচিত হয়ে যায়, তার আলাদা চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য আর থাকে না। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের যদি কৌশলগত ও কারিগরি প্রশিক্ষণ ভারত থেকে নিতে হয়, ভারত থেকে অস্ত্র-সরঞ্জাম কিনে সামরিক শক্তি বাড়াতে হয় তাহলে বাংলাদেশের আলাদা আর কিছু থাকে না। কোনো বিবেচনাতেই বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ভারতের সামরিক বাহিনীর সম্পূরক বাহিনীতে পরিণত হতে পারে না। সে রকম হলে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তাই প্রশ্নের মুখে পড়ে। বাংলাদেশের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন জাতীয় প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা সুরক্ষার জন্য। কোনো সমারিক উচ্চাভিলাষ বাংলাদেশের নেই। এখন যদি এ ক্ষেত্রে ভারতীয় প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণই প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা সামরিক বাহিনীতে পরিণত করার সংকল্প ও অঙ্গীকারের আর কোনো মানে থাকে না। জনগণের কষ্টার্জিত অর্থেই সামরিক বাহিনী ও বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনী লালিত-পোষিত হয়ে থাকে। ভারত যদি সামরিক বাহিনীর সব কিছুই করে দেয়, বিজিবি যদি রাখীবন্ধনে সন্তুষ্ট থাকে তবে প্রতি বছর এত বিপুল অর্থ ব্যয়ের আর প্রয়োজন কি! বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে, ভারত নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের সঙ্গে কোনো প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করতে পারেনি, যেমনটি করেছে বাংলাদেশের সঙ্গে। বলা যায়, সে বাংলাদেশকে বাধ্য করেছে এই সমঝোতা স্মারকগুলো স্বাক্ষরে। এখানে তার বড় রকমের একটা বিজয় হয়েছে। এ জন্যই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের এত প্রশংসা ভারতের।
বাংলাদেশের আমলাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে ভারতে। সামরিক বাহিনীকেও একটি বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। বাইরে থাকা বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই যে সর্বক্ষেত্রে ও পর্যায়ে ভারতের ওপর নির্ভরতা, এটা কি দেশের জন্য কোনো ইতিবাচক বার্তা বহন করে? পরিতাপের বিষয়, কি কি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তার শিরোনাম কেবল আমরা জানতে পেরেছি। তাও জানতে পেরেছি ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে। এসবের বিস্তারিত দেশের মানুষ এখনো জানতে পারেনি। বারবার বিভিন্ন মহল থেকে তাকাদা দেয়ার পরও আমাদের সরকার টুঁ-শব্দটি করেনি। মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা বারবার একই কথা বলেছেন, দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি বা সমঝোতা আওয়ামী লীগ বা সরকার করবে না। চুক্তি ও সমঝোতার শিরোনামগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের মানুষ মন্ত্রী ও নেতাদের এ কথায় আর আস্থা রাখতে পারছে না। যা-ই করা হোক, দেশের মানুষকে আস্থায় রেখেই করা উচিত। সরকার এ ক্ষেত্রে সেই ঔচিত্যবোধের পরিচয় দিতে পারেনি। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা এই যে, ভারতের ইচ্ছা পূরণে এতটুকু কার্পণ্য করা হয়নি। অথচ এতগুলো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে বা অনুকূলে একটি চুক্তি বা সমঝোতাও হয়নি। তিস্তা চুক্তি হয়নি, অভিন্ন নদীর পানি নণ্টনে কোনো সমঝোতা হয়নি। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, বাণিজ্য অসমতা নিরসনে কোনো সমঝোতার দেখা মেলেনি। প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে তাহলে বাংলাদেশ কি পেল? প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে এলে চুক্তি ও সমঝোতাগুলোর বিস্তারিত জনগণকে জানানো হবে বলে আমরা আশা করি। অতঃপর যা কিছুই করা হোক, দেশ ও জনগণের স্বার্থে, কল্যাণে ও উন্নয়নে করা হবে এবং জনগণের আকাক্সক্ষা-অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের সমর্থন নিয়ে করা হবে, এটাই কাম্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন