দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওরগুলোর ফসল তলিয়ে যাওয়ার জন্য বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজে অর্থ লোপাটসহ নানা অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করা হচ্ছে। বিশেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দিকে আঙ্গুল উঠেছে। গত রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ফসলডুবির জন্য পানি উন্নয়ন বোর্র্ডের কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সুনামগঞ্জ নেত্রকোনা সিলেট ও কিশোরগঞ্জে একলাখ ৭১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমির ধান পানিতে ডুবে গেছে। এতে ওই তিনজেলায় ২কোটি ৫ লাখ মণ ধান কৃষকের ঘরে উঠছে না। ফসল ডুবির ঘটনায় মোট ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। বাঁধ ভেঙ্গে ফসলডুবির ঘটনায় গত রোববার সকালে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বিশেষ সভায় তোপের মুখে পড়েছে পানি উন্নয়নবোর্ডের কর্মকর্তারা। সভাশেষে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সুনামগঞ্জের ৭০ ভাগ জমির ফসল ডুবেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতিও দায়ী। এগুলো খতিয়ে দেখার জন্য এবং দায়ীদের চিহ্নিত করার জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্তকমিটি করার জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ করবো। অপরদিকে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার ও সুনামগঞ্জ জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে জেলা মুক্তিযাদ্ধা সংসদ ও সদর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে।
হাওর এলাকায় ক্ষেতের ফসল নষ্ট হতে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। হাওর এলাকার জমি একফসলি। এক মওসুমের ফসল দিয়েই তাদের সারাবছর চলতে হয়। রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে হাওর অ্যাডভোকেসির যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফুজ্জামান বলেছেন, গত ১১ থেকে ১৩ মার্চ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর এলাকা পরিদর্শনে তারা বাঁধ সংস্কারের কাজে নানা অব্যবস্থাপনা দেখতে পেয়েছেন। তারা বলেছেন, এবার হাওরের মানুষ দুর্ভিক্ষে পড়বে। আগের বছরগুলোতে হাওর পানিতে ডুবে গেলেও ধান পাকা থাকে। তখন ধান পানির তল থেকে হলেও কিছু না কিছু কেটে আনা হয়। এবার ধানক্ষেতে থোড় আসেনি। তার আগেই তলিয়ে গেছে, এমন বিপর্যয় কখনো দেখিনি। তারা বলেছেন, টাকার সংকটে নয় বরং বিষয়টি খুব স্পষ্ট যে দুর্র্র্নীতির মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এদিকে ফসলডুবির ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হাজার হাজার কৃষক আন্দোলনে নেমেছে। তারা জেলার বিভিন্ন উপজেলাজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সভা করছে। এসব সমাবেশে পাউবোর কাজের সুষ্ঠু তদন্ত দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার ও পিআইসির সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার, তদন্তের আগে ঠিকাদারদের বিল না দেয়া জরুরি ভিত্তিতে খোলাবাজারে ১০ টাকা কেজির চাল বিতরণ শুরু, ইজারাকৃত জলমহালের ইজারা বাতিল সহজ শর্তে কৃষিঋণ প্রদান গ্রামে গ্রামে রেশনিং প্রথাচালুসহ বিভিন্ন দাবিতে ভুক্তভোগীরা সোচ্চার রয়েছেন।
হাওর এলাকায় ফসল তলিয়ে যাওয়ায় গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। ফসলহানিতে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে দেশের বিত্তবান ও স্বচ্ছল ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। এবারের ক্ষয়ক্ষতিকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছন তিনি। এধরনের পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ দিতে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবার হাওর এলাকায় ফসল রক্ষার জন্য তৈরি বেড়িবাঁধ উপচে কৃষকের জমিতে পানি প্রবেশ করেছে। সঙ্গত বিবেচনা থেকেই প্রশ্ন উঠেছে সংস্কারের নামে যে মোটা অংকের টাকা বরাদ্দ ছিল তা দিয়ে কি বাঁধের কোন কাজই করা হয়নি? মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণের টাকা খরচ নিয়ে প্রতিবছরই নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। দেখা যায়, বন্যা দেখা দিলে একধরনের তড়িঘড়ি করে পাউবো বাঁধ তৈরিতে তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে অপচয় ছাড়া আর কিছুই হয় না। সে কারণেই হাওর এলাকায় কৃষকরা চৈত্রের টানাবর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে যে সর্বস্বান্ত হয়েছে। এ দায় থেকে পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মুক্ত হবার কোন সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে প্রতিমন্ত্রীসহ অনেকেই এনিয়ে কথা বলেছেন। তিনি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বলেছেন। তবে এটি যেন কেবল কথার কথা না হয়। আমরা আশা করব, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঠিকাদার এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনৈতিক সম্পর্ক দুর্ভোগ দুর্দশার মূল কারণ। আমরা মনে করি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দাবির যেসব যৌক্তিক দিক রয়েছে সেগুলো দ্রুততার সাথে বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবায়ন করা উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন